চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারীদের হোতা সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম

সারা দেশজুড়ে আলোচিত ঘটনা ছিল সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের ধর্ষণকাণ্ড। এ ঘটনায় জড়িতদের পাশাপাশি নেপথ্যের কুশীলবদের ধরতে জোরালো দাবি ওঠে রাজপথে। তবে নেপথ্যের খলনায়করা অধরাই থেকে যান।চাদাবাজি ও ধর্ষণকাণ্ডে জড়িতদের নেতা নাজমুল ইসলামকে করা হয়েছে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি।

সোমবার (১২ সেপ্টেম্বর, ২০২১) কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য জেলা ও মহানগর কমিটির অনুমোদন দেন।

নাজমুল ইসলামকে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও রাহেল সিরাজকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। আর মহানগর কমিটিতে কিশওয়ার জাহান সৌরভকে সভাপতি ও মো. নাঈম আহমদকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদে স্থান পেয়েছেন সিলেট ছাত্রলীগের ৬ নেতা। জেলা থেকে জাওয়াদ ইবনে জাহিদ খান, বিপ্লব কান্তি দাস, মুহিবুর রহমান মুহিব ও কনক পাল অরূপ এবং মহানগর থেকে হুসাইন মোহাম্মদ সাগর ও সঞ্জয় পাশী জয়কে কেন্দ্রীয় সদস্য করা হয়েছে।

তবে বিতর্কিত নাজমুল ও রাহেল সিরাজকে কমিটিতে রাখায় তাৎক্ষণিকভাবে কেন্দ্রীয় সদস্য পদ প্রত্যাখ্যান করেছেন ছাত্রলীগ নেতা জাওয়াদ ইবনে জাহিদ খান ও মুহিবুর রহমান মুহিব।

কমিটি ঘোষণার পর সিলেট ছাত্রলীগে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেছেন, সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কমিটির বিরুদ্ধে ঝাড়ু প্রদর্শনও করেছেন তারা।

বিক্ষোভ মিছিল শেষে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার হোসেন সামাদ বলেন, ঘোষিত কমিটির সভাপতি এমসির ছাত্রাবাসে তরুণী ধর্ষণের মূলহোতা। আর সাধারণ সম্পাদক ক্লাস ফাইভ পাস করেছে কিনা সন্দেহ। অসংখ্য চেক ডিজওনার মামলারও আসামিও সে। ধর্ষকদের শেল্টারদাতা, চোর-বাটপারদের দিয়ে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে পূণ্যভূমি সিলেটকে কলুষিত করতে জেলা ছাত্রলীগের কমিটিতে দেওয়া হয়েছে। আমরা এই কমিটি আশা করিনি, মেনে নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ সব সময় ছাত্রত্ব দেখে ছাত্রলীগের কমিটির দায়িত্ব দেওয়ার কথা। কিন্তু যাদের কোনো ছাত্রত্ব নেই তাদের রেখেই কমিটি দেওয়া হয়েছে। উল্যেখ্য নাজমুল ইসলাম হাইস্কুলের গণ্ডিও পার করেনি।

মাদক, এমসি কলেজে ধর্ষণকাণ্ড, ছিনতাই, চাদাবাজ, নারী নির্যাতনসহ নানা অপরাধের কারণে আলোচিত ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল। ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী ‘শুটার’ আনসার নাজমুল ইসলাম এর নিয়ন্ত্রণে অপরাধ পরিচালনা করে। দলীয় সূত্র জানায়, এমসির বহুল আলোচিত ধর্ষণকাণ্ডে আসামিদের প্রত্যেকেই ছিলেন নাজমুলের অনুসারী। ধর্ষণের ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসামিদের সঙ্গে নাজমুলের একাধিক ছবিও ভাইরাল হয়। এছাড়াও ৭/৮টি মামলার আসামি নাজমুল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি বিশেষ ইউনিটের হিটলিস্টেও আছেন।

পুলিশ জানায়- জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি নাজমুল ইসলামের কর্মী শুটার আনসারের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ১০-১২টি। নানা ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। তবে- বেশির ভাগ মামলাই হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন করে গুলির ঘটনায়। গত ১০ই অক্টোবর সৈয়দপুর আবাসিক এলাকায় আরেকটি ঘটনা ঘটিয়েছিল শুটার আনসার ও তার অপরাধ সহযোগী মুন্না, রবিন, শামীম, সুলতান, জাবির সহ কয়েকজন। চাঁদা না দেয়ায় ওইদিন শুটার আনসারের নেতৃত্বে সৈয়দপুর এলাকার এডভোকেট সৈয়দ মুক্তাদির আলীর বাসায় আগ্নেয়াস্ত্র উচিয়ে তাণ্ডব চালায়। তারা এ সময় আইনজীবীর বাসা তছনছ করা ছাড়াও দু’টি মোটরসাইকেল ভেঙে ফেলে। এ ঘটনায় আইনজীবী বাদী হয়ে মামলা করেছেন। এর আগে ২০১৯ সালের ৩রা জুলাই শুটার আনসারের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়েছিল খাদিমপাড়া ইউনিয়ন পরিষদে। সেখানে তারা পুলিশের উপরও হামলা চালায়। হামলায় কয়েকজন পুলিশও আহত হন ও রাস্তায় চলাচলরত অবস্থায় যানবাহনে তাণ্ডব চালায়। এ ঘটনায় আনসার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে শাহ্‌পরান থানায় পুলিশ এসল্ট মামলা হয়েছে। একই বছরের ১৮ই জানুয়ারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থীদের উপর হামলা ও প্রকাশ্য গুলিবর্ষণ করেছিল শুটার আনসার ও তার সহযোগীরা। এ ঘটনায় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যক্ষ মো. আব্দুল্লাহ বাদী হয়ে আনসারসহ হামলাকারীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করেছিলেন। ২০১৪ সালে টিলাগড়ের পাম্প মালিক মুজিবুর রহমানের টাকা ছিনতাইয়ের মিশনে নেতৃত্ব দিয়েছিল শুটার আনসার। ২০১৬ সালে শাহ্‌পরান থানায় শুটার আনসারের বিরুদ্ধে দু’টি ও ২০১৮ সালে আরো একটি মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশ জানায়- নানা অপরাধকাণ্ডের কারণে মামলা করা হলে এখন পর্যন্ত ৫-৬ বার গ্রেপ্তার হয়েছে শুটার আনসার। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার র‌্যাবের হাতে আটক হওয়ার মাস খানেক আগে সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ঘটনায় সে র‌্যাবের হাতে আটক হয়েছিল। খাদিমপাড়া ইউনিয়ন পরিষদে হামলার ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়। এছাড়া বিভিন্ন ঘটনায় আরো কয়েকবার আটক হয়। আটক হয়ে কারাগারে গেলেও বেরিয়ে এসে সে একইভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এমসি কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন- শুটার আনসার ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে সাইফুর ও রবিউলের সঙ্গে কলেজ নিয়ন্ত্রণে ছিল তারও। একবার হেলমেট পরে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে গুলি করে আনসার। এ ঘটনার পর তার নাম আলোচিত হলেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এমসি কলেজের মন্দিরের টিলায় শুটার আনসার, সাইফুর, রবিউলসহ তাদের সিন্ডিকেট অবস্থান করতো। আর সেখানে প্রতিদিনই ঘটতো ছিনতাইয়ের ঘটনা।

ছাত্রলীগের একাধিক নেতা জানান, নগরের টিলাগড় কেন্দ্রিক ছাত্রলীগের গ্রুপ রাজনীতির নিয়ন্ত্রক জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রণজিত সরকারের অনুসারী নাজমুল। ওই এলাকায় অবস্থিত এমসি কলেজ ও ছাত্রাবাস, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও সরকারি কলেজের নিয়ন্ত্রণ নিতে বিবাদ লেগেই থাকে।

এসব বিরোধের জেরে ২০১০ সাল থেকে এ যাবত টিলাগড়ে অর্ধ ডজন নেতাকর্মী খুন হয়েছেন। এর মধ্যে ২০১০ সালের ১২ জুলাই উদয়েন্দু সিংহ পলাশ, ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট করিম বক্স মামুন, ২০১৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর জাকারিয়া মোহাম্মদ মাসুম, ১৬ অক্টোবর ওমর আহমদ মিয়াদ, ২০১৮ সালের ৯ জানুয়ারি তানিম খান এবং সবশেষ গত বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে খুন হয়েছেন অভিষেক দে দ্বীপ।

সিলেটের ছাত্রলীগের একাধিক নেতাকর্মীরা দাবি জানিয়ে আসছিলেন, কোনো চিহ্নিত সন্ত্রাসী কিংবা বিতর্কিত কাউকে যেন কমিটিতে স্থান দেওয়া না হয়। কিন্তু বিগত দিনে চাঁদাবাজি, টেন্ডার লুট, খুনাখুনি, হামলা ও ধর্ষণকাণ্ডের ঘটনায় একাধিবার বিলুপ্ত হয়েছিল কমিটি। সেই বৃত্তে বন্দি থেকে এবারো জেলা ছাত্রলীগের কমিটি দেওয়া হলো।

সূত্র জানায়, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি পদে নাজমুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক পদে রাহেল সিরাজের নামে নানা ধরনের সমালোচনা থাকলেও তাদেরই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মহানগর কমিটিতে সভাপতি নাইম ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক পদে কিশোয়ার জাহান সৌরভকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। নাঈম আগের কোনো কমিটিতে না থাকলেও সৌরভ মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য ছিলেন।

বিভিন্ন অপরাধে সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি বহুবার বিলুপ্ত করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা প্রকৌশলীকে লাঞ্ছিত করার দায়ে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি পঙ্কজ পুরকায়স্থকে বরখাস্ত করা হয়। এরপর ২২ জানুয়ারি সিনিয়র সহ-সভাপতি হিরণ মাহমুদ নিপুকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু নিপুর নেতৃত্বে ওই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর নগরের কোর্ট পয়েন্টে সিপিবির সমাবেশে হামলা করে ছাত্রলীগ। এ ঘটনায় হিরণ মাহমুদ নিপুকেও বহিষ্কার করা হয়।

সবশেষ ২০১৪ সালে নতুন কমিটি দিলেও তিন বছরের মাথায় ২০১৭ সালে সেই কমিটি বিলুপ্ত করা হয় সাধারণ সম্পাদক এম রায়হান চৌধুরী নিজ দলের কর্মীকে খুনের ঘটনায়। এরপর দীর্ঘদিন কমিটি আলোর মুখ না দেখায় নেতাকর্মীদের অনেকে বিভিন্ন অপরাধে জড়ান। সবশেষ গত বছরের শেষের দিকে এমসির ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের ঘটনায় সংগঠনটির ইমেজ সংকট তলানিতে পৌঁছেছে।

এ বছরের ১৩ মার্চ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি/সম্পাদক সিলেটে কর্মীসভা করে গেলেও ৬ মাস কমিটি হাতে আটকে রাখেন।

২০১৭ থেকে ২০২০ সাল, তিন বছরের বেশি সময় কমিটি না থাকা ছাত্রলীগ ২০২১ সালের শেষে এসে কমিটির দেখা পেলেও বিতর্কিতরা নেতৃত্বে আসায় ফের বিচ্ছিন্নভাবে পথ চলতে শুরু করেছে ক্ষমতাসীন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।

সংগঠনের সাবেক দায়িত্বশীলরা বলছেন, কমিটি গঠনে নেত্রীর নির্দেশনা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না। যোগ্য নেতৃত্ব থাকলে কেউ অপরাধ কর্মে জড়ানোর সাহস পেতো না।

Related Posts