বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলন-সংগ্রামের অন্যতম জাতীয় রাজনৈতিক নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৯৪৮ সালের ২৪ জানুয়ারি তিনিই প্রথম পাকিস্তানের গণপরিষদে (করাচিতে) বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেছিলেন। সেদিন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সেই প্রস্তাবনাতে বলেছিলেনঃ
Out of six crores and ninty lakhs people inhabeting this state, 4 crores and 40 lakhs of people speak Bengali language. So, sir, what should be the State language of the state? The state language of the state should be the language which is used by the majority of the people of the state, and for that, sir, I consider that Bengali language is a lingua franca of our state.
ওই অধিবেশনে মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসহ বাঙালী পার্লামেন্ট সদস্যদের একাংশ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন দিলেও মুসলিম লীগ সমর্থিত এমপিরা এর বিপক্ষে অবস্থান নেন।
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনের প্রথম দিনে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবটির ওপর দুটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। উত্থাপিত প্রস্তাব নিয়ে গণপরিষদে তুমুল তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এই প্রস্তাবটি ও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা এবং একটি সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা থেকে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই এর উদ্দেশ্য’। এই প্রস্তাবের আরো বিরোধিতা করেন পূর্ব-বাংলার গণপরিষদের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন। তিনি বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীর মনোভাব হচ্ছে একমাত্র উর্দূকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে’।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম ১৯৮৬ সালের ২ নভেম্বর। ব্রাহ্মণবাড়িয়া (বর্তমান কুমিল্লা) জেলার রামরাইল গ্রামে। বাবা জগবন্ধু দত্ত ছিলেন কসবা আদালতের সেরেস্তাদার। শৈশবেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মা মারা যান। ১৯৩২ সালের ৩১ মার্চ তার বাবা মারা যায়।
পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারের কাছে। তারপর পাঠশালা ও প্রাইমারী স্কুলে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। এরপর নবীনগর উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ওই বিদ্যালয় থেকে ১৯০৪ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ওই বছর তিনি কুমিল্লা কলেজ ভর্তি হন। ১৯০৬ সালে কুমিল্লা কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এফ এ পরীক্ষায় পাস করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতায় যান। বিএ ভর্তি হন কলকাতার রিপন কলেজে। ১৯০৮ সালে ধীরেন্দ্রনাথ কলকাতার রিপন কলেজ হতে বিএ পরীক্ষায় উত্তির্ন হন। ওই কলেজ থেকেই ১৯১০ সালে আইন পাস পাশ করে বের হন।
১৯০৬ সালের ৭ ডিসেম্বর সুরবালা দেবী সহধর্মীনি করেন। তাদের সংসারে ১৯১১ সালে জন্ম হয় প্রথম সন্তান আশালতা দত্তের। ১৯১৯ সালে জন্ম হয় পুত্র সঞ্জীব দত্তের। ১৯২৬ সালে জন্ম হয় কনিষ্ঠ পুত্র দীলিপ দত্তের।
১৯১০ সালের ১ মার্চ থেকে ১৯১১ সালের ১ জানুয়ারী পর্যন্ত তিনি কুমিল্লার বান্দরা উচ্চ ইওংরেজী বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করেন। ১৯১১ সালে তিনি আইন পেশায় নিযুক্ত হন। রাজনৈতিক কারণে তাকে বার বার জেলে ও আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। যার ফলে দীর্ঘ দিন এই পেশায় সময় দিতে পারেননি। এরপর ১৯৩১ সালের নভেম্বর মাসে আবার তিনি আইন পেশাই ফিরে আসেন। আইন পেশাকে ব্যবসা হিসেবে না দেখে সত্যিকারভাবে সেবা হিসেবে দেখেছেন। যার ফলে তিনি গরীব মানুষের মামলা বিনা টাকা পরিচালনা করেছেন। ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। সদস্য নির্বাচিত হয়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ত আইন সংশোধণ এবং বঙ্গীয় কৃষিঋণ গ্রহীতা ও বঙ্গীয় মহাজনী আইন পাশের জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯১৯ সালে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে (ময়মনসিংহ) অংশগ্রহণ করেন। ১৯২১ সালে কুমিল্লায় ‘মুক্তি সংঘ’ নামে একটি সংগঠন গঠন করেন। ১৯২৩ সালে কুমিল্লায় ‘অভয় আশ্রম’ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯২৯ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। এ সময় তিনি সাময়িকভাবে আইন ব্যবসা ছেড়ে দেন।
১৯৩০ সালের ২ জুলাই আইন অমান্য আন্দোলনের জন্য তাকে ব্রিটিশ সরকার গ্রেফতার করে। কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৩১ সালের নভেম্বর মাসে আবার তিনি আইন পেশাই ফিরে আসেন। ওই বছর তিনি কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৩২ সালের ৯ জানুয়ারি বিপ্লবীদের ওপর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে আবার ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে কারাগারে যেতে হয়। ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কারাগার থেকে মুক্তি পান।
১৯৩৬ সালে ত্রিপুরা জেলা বোর্ডের (বর্তমান কুমিল্লা জেলা) সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার তিনি সদস্য নির্বাচিত হ্ন। এ সময় তিনি বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ত আইন সংশোধন, বঙ্গীয় কৃষিঋণ গ্রহীতা ও বঙ্গীয় মহাজনী আইন পাশের সাথে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিলো।
১৯৪০ সালের ১৪ ডিসেম্বর যুদ্ধবিরোধী প্রচারণা চালানোর অপরাধে আবার তাকে ব্রিটিশ সরকার গ্রেফতার করে। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড় আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৩ সালে কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। ১৯৪৫ সালের জুন মাসে বঙ্গীয় বিধান সভার অধিবেশনে বাজেট আলোচনাকালে ধীরেন্দ্রনাথ কর্তৃক একটি ছাটাই প্রস্তাব বিপুল ভোটে পাশ হয়। ফলে নাজিমউদ্দিনের মন্ত্রিসভার পতন ঘটে।
১৯৪৬ সালে কংগ্রেস দল থেকে নোমিনেশন বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ওই বছর পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য ডিসেম্বরে পূর্ববঙ্গ হতে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ হিসেবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে স্বীকৃতি লাভ করেন।
তিনি ১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান আইনসভায় সর্বপ্রথম বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য ঐতিহাসিক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তখন থেকেই সুত্রপাত হয় ভাষা আন্দোলনের। তিনিই ভাষা আন্দোলনের পটভূমি রচনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যার ধারাবাহিকতায় ৪ বছর আন্দোলন-সংগ্রামের পর সৃষ্টি হয় ৫২’ র ২১ ফেব্রুয়ারী। ১৯৫২ সালে তিনি সংসদে মহানভাষা আন্দোলনের পক্ষে জোরলো সমর্থন জানান। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রণ্টের বিপুল বিজয়ের কারণে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। ওই বছর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আবার আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৫৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিশেষ অনুরোধে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন তিনি। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি মন্ত্রিসভায় ছিলেন।
১৯৬০ সালে সামরিক শাসনের সময় দেশের জাতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উপরেও ‘এবডো’ আইন প্রয়োগ করা হয়। ১৯৬৪ সালে আইনজীবী এসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। ওই বছর জিন্নাহ’র নির্বাচনী প্রচারে সমর্থন দেয়ার জন্য দায়ে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সরকার তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখে। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রামে তিনি লড়াকু সৈনিকের ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। গভীর রাত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেশব্যাপী গণহত্যা চালায়। শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী থেকে সকল শ্রেণি, বিশেষত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। মানুষ অনুভূতিহীন হয়ে পড়ে। কারো বুঝতে অসুবিধে হল না যে, পাকিস্তানীরা বাঙ্গালীকে কোনো অধিকার দিবে না, বরং আন্দোলন –সংগ্রামকারীদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য ওরা হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে। শুরু হলো প্রতিরোধের পালা।
তখন শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে দেশত্যাগ করে ভারতে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন মহল পরামর্শ দেয়। কিন্তু তিনি নাছোড় বান্দা। দেশ মাতৃকাকে ছেড়ে যাবেন, এ কথা সবাইকে স্পস্ট জানিয়ে দিলেন। ভাবতে শুরু করলেন দেশে এই সংকটময় মুহূর্তে কি করা যায়, এ সব কথা। কয়েক জনের সাথে আলাপও করেছিলেন।
অবশেষে ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে পাকিস্তানি নরপশু হানাদার বাহিনী ৮৬ বছর বয়স্ক শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে ও তাঁর ছোট ছেলে দিলিপ দত্তকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে ময়নামতি সেনানিবাসে যায়। শুরু করে নির্মম অত্যাচার, হাত-পা ভেঙে দেয়, চক্ষুদ্বয় উৎপাটন করে। ১৯৭১ সালের নববর্ষের দিন ১৪ এপ্রিল তাকে হত্যা করে পাকিস্তানি জানোয়ার বাহিনী।
courtesy: somewhereinblog