২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরে মাত্র দেড় মাসের মাথায় ঘটে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। সে বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারী ঢাকার পিলখানায় অবস্থানরত বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) সদস্যদের করা বিদ্রোহে নিহত হন ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা সহ অন্তত ৭৪ জন। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৮৫০ জনকে অভিযুক্ত করে মামলা করা হয় এবং বিলুপ্ত করা হয় বাংলাদেশ রাইফেলস। দায়ের হওয়া হত্যা মামলায় হাইকোর্টের বিচারিক আদালত ১৩৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২২৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়। অপরাধের ধরন অনুসারে অনেক আসামীকে হাই সিকিউরিটি কারাগারেও প্রেরণ করেন হাইকোর্ট।
অন্যদিকে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীতে রাখাইনে “মানবিক করিডোর” ইস্যুতে গভীর বিভক্তি দেখা দিয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, মানবিক করিডোরের বিরোধিতা করায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনকে অপসারণ করা হয়েছে। তৌহিদ হোসেন এই ইস্যুতে সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ অংশের সঙ্গে একমত ছিলেন। তবে তাকে একটি ক্লাবের বিল সংক্রান্ত অজুহাতে অপসারণ করা হয়। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, যিনি মার্কিন নাগরিক, এই করিডোরের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন। ইউনূস ও খলিলুর রহমান, তৌহিদ হোসেনের অপসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ইউনুস ও খলিলুরের এই পক্ষটা চায়, যেভাবেই হোক হুবহু মার্কিন প্রেস্ক্রিপশন অনুযায়ী রাখাইনে মানবিক করিডোর দিতে, কিন্তু পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও জেনারেল ওয়াকার বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও স্বার্থ সবার আগে নিশ্চিত করতে চায়, এখানেই দ্বন্দের সূত্রপাত। সেনাবাহিনীর এই বিভক্তি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের প্রভাব ভবিষ্যতে কী রূপ নেবে, তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
২০২৪ সাল, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ১৫ বছর পরে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নামে ৫ম মেয়াদে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টার মুখে দেশ ত্যাগে বাধ্য করার পরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে নির্বাহী ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রন করছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার সহযোগীরা। ৮ আগস্ট শপথ নেওয়ার পর থেকে একে একে কারাগার থেকে বেরিয়েছেন নিরাপত্তাবাহিনীর কালো তালিকায় থাকা সন্ত্রাসী এবং জঙ্গীরা। শুধু তাই নয় ছাত্র আন্দলনের নামে একাধিক জেলখানায় হামলা চালিয়ে আসামীদের মুক্ত করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। আবার পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদেরও কেউ কেউ দেশে ফিরে আসছেন। কারাগার থেকে বেরিয়ে এসব সন্ত্রাসী ফের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন।
দেশ জুড়ে যখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন কালো তালিকাভুক্ত সন্তাসীরা, ঠিক এর মাঝেই মুক্তি পেতে শুরু করেছেন পিলখানা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকা শতাধিক বিডিআর সদস্যরা। ক্ষমতার পালাবদলে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার তদন্তে আবারও নতুন করে বিচারিক প্রক্রিয়া চালু করেছে ড. ইউনূস গং। সম্প্রতি মহাখালীর রাওয়া ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান মন্তব্য করেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ড সম্পূর্ণটাই তদানীন্তন বিডিআর দ্বারাই হয়েছে, এখানেই ‘ফুলস্টপ’ এবং এই ঘটনায় ‘ইফ’ এবং ‘বাট’ আনলে বিচারিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। আর সেনাপ্রধানের মতামতের তোয়াক্কা না করেই ক্যাঙ্গারু কোর্টের মাধ্যমে জামিনে মুক্তি এবং খালাস দেওয়া হচ্ছে সেনা হত্যাকাণ্ডে জড়িত মিলিটারি ট্রেইনিং প্রাপ্ত আসামীদের, যাদের মধ্যে রয়েছেন অর্ধশতাধিকই হাই প্রোফাইল আসামী। বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ক্যাঙ্গারু কোর্টের মাধ্যমে ৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৩৩১ জন মিলিটারি ট্রেইনিং প্রাপ্ত আসামীকে মুক্তি দিয়েছেন ইউনূস গং।
মিলিটারি ট্রেইনিং প্রাপ্ত হাই প্রোফাইল আসামীদের মুক্তির ঘটনায় জীবননাশের ঝুঁকির কথা প্রকাশ করেছেন অনেক নিহত সেনা সদস্যদের পরিবার। তারা বলছেন, অনেক শহীদ সেনা সদস্যের পরিবাররা এবং সাক্ষীদের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। কেননা তারা মনে করছেন, এই আসামীদের মুক্তি তাদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। হাইকোর্ট এবং আপিল বিভাগ থেকে আসা রায়কে উহ্য করে ক্যাঙ্গারু কোর্টের মাধ্যমে নতুন করে বিচারিক প্রক্রিয়া চালুর বিষয়টি এখন শহীদ পরিবারের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। তারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা ব্যবহার করে বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেছেন। আসামীরা যেমনটা জামিনে বের হতে পেরেছেন, তেমনি নিশ্চিতভাবে আমাদের করা আপিলের বিরুদ্ধে প্রভাব খাটাতে তাদের কোন ভোগান্তিই পোহাতে হবে না। আসামীপক্ষের প্রভাবে মামলা দুর্বল হয়ে যাওয়ারক্রম। এবং ইউনূস গং প্রভাব খাটিয়ে আদালতে মনগড়া নিয়মে বিচারিক কার্যক্রম চালাচ্ছেন। যাকে খুশি তাকে জামিন দিচ্ছেন যাকে খুশি তাকে খালাস দিচ্ছেন। মীমাংসিত ঘটনাকে নতুন করে সাজানোর বিষয়টি রীতিমত পাওয়ারের মিস-প্র্যাকটিস।
মিলিটারি ট্রেইনিং প্রাপ্ত এবং হাই প্রোফাইল আসামীদের এমন মুক্তির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ড. ইউনূসের এমন পদক্ষেপ সার্বিকভাবে দেশের আইনি ও সামাজিক কাঠামো, আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি এবং জনগণের মনে ন্যায়বিচারের ধারণার উপর গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। সর্বোচ্চ আদালত থেকে আসা রায়কে ফিরিয়ে দিয়ে আপনি যখন নতুন করে আবারও বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করবেন এটা আইনের শাসনের দুর্বলতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ছাড়া অন্য কিছুই নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের এমন পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে, নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক মহলে এই ঘটনাকে ন্যায় বিচারের অভাব হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। এবং অন্তর্বর্তী সরকার যদি নিজের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য এই পদক্ষেপ নিয়ে থাকে, তাহলে খুব শীঘ্রই বাংলাদেশ রাজনৈতিক ভাবে পুরোপুরি অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। কারন এই মুক্তি পাওয়া হাই প্রোফাইল ক্রিমিনালরাই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে।
মীমাংসিত বিষয়কে আবারও মর্গে ওঠানোর বিষয়টি শুধু মাত্র বর্তমান নয় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও একটি খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে, বলে মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে পারে এবং এর মাধ্যমে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। মিলিটারি ট্রেনিংপ্রাপ্ত এমন হাই প্রোফাইল আসামীদের নিজেদের লক্ষ্য হাসিলে সন্ত্রাসী কিংবা জঙ্গী গোষ্ঠী গড়ে তুলতে পারে। যা দেশের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ন। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় আসামীরা তাদের অপরাধের শাস্তি এড়িয়ে যাচ্ছে, যা নিশ্চিতভাবে দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ার বিষয়টি ইঙ্গিত করছে। মূলত এটি বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে আরও বাড়িয়ে দেবে এবং বিচার বিভাগকে চাইলেই কলুষিত করা যায় তার প্রমাণ রেখে যাওয়া হচ্ছে। হাই প্রোফাইলের এই আসামীদের মুক্তি আইনের শাসনের প্রতি জনগণের আস্থা কমিয়ে দেবে এবং নিঃসন্দেহে দেশে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাবে।
অচিরেই দেশে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মত ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, মিলিটার ট্রেইনিং প্রাপ্ত এবং হাই প্রোফাইল আসামীদের অবাধে বিচরণ বড় ধরনের সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি করে। কারন এই গোষ্ঠী পুরোটাই নিয়ন্ত্রনের বাহিরে থাকবে সবসময়। ইতোমধ্যেই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অনেক অবনতি ঘটেছে, এখনো নিয়ন্ত্রনে নেই সার্বিক পরিস্থিতি। এমন সময়ে এসে এ ধরনের আসামীদের মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি আসলেই খুব স্পর্শকাতর। এই আসামীরাই কয়েকদিন পরে রাজনৈতিক মেরুকরণ করবে, যা ধীরে ধীরে তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। আর রাজনৈতিক উত্তেজনা থেকে এই ক্রিমিনালদের সমন্বয়ে আবারও বিরাট কোনো স্বশস্ত্র দাঙ্গার ঘটনাও ঘটতে পারে। এমনকি পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মত ঘটনা অন্য কোনো বাহিনীতেও হতে পারে।