স্বাধীনতাবিরোধী দের পুনর্বাসনে আওয়ামি লিগের ভূমিকা
আখতারুজ্জামান আজাদ
মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশের শাসনক্ষমতা ছিল মূলত আওয়ামি লিগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির হাতে। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতারা (জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ) ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন সেনাপ্রধান হিশেবে। ক্ষমতা দখলকালে তাদের কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না, দুজনই রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন ক্ষমতাপ্রাপ্ত হওয়ার পরে। বলাই বাহুল্য— মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বা মুক্তিযুদ্ধের আগে জিয়া-এরশাদের রাজনৈতিক দলের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে তারা কোনোভাবেই প্রাসঙ্গিক ছিলেন না। ফলে, জিয়া-এরশাদ সেনাশাসক হিশেবে বা বিএনপি-জাতীয়পার্টি দলীয়ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদেরকে রাজনীতিতে কীভাবে পুনর্বাসিত করেছে, তা হিশাব করা সহজ ও সরলরৈখিক। বলে দিলেই হয়ে যায়— জিয়া-এরশাদ বা বিএনপি-জাতীয়পার্টি অমুক-অমুক স্বাধীনতাবিরোধীকে মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছে বা দলে পদ দিয়েছে। আওয়ামি লিগ ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত বা ২০০৮ থেকে অদ্যাবধি স্বাধীনতাবিরোধীদেরকে কীভাবে পুনর্বাসিত করেছে, তাও হিশাব করা সহজ। সহজ না আওয়ামি লিগ ১৯৭২-এর জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫-এর আগস্ট পর্যন্ত স্বাধীনতাবিরোধী দেরকে কীভাবে পুনর্বাসিত করেছে। এই হিশাব মোটেই সরলরৈখিক না, বরং যারপরনাই জটিল ও গোলমেলে। এই গোলমাল রীতিমতো দেশবিভাগের র্যাডক্লিফ রোয়েদাদের মতো। এই গোলমেলে হিশাব কষতে মনস্থির করাটাও অত্যন্ত দুরূহ একটা ব্যাপার।
স্বাধীনতাবিরোধী দল বলতে বর্তমান বাংলাদেশ মূলত জামায়াতে ইসলামিকেই চেনে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত যাদেরকে মৃত্যুদণ্ড, আমৃত্যু কারাদণ্ড বা নব্বই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে; দু-একজন বাদে তাদের সবাই যেহেতু জামায়াতে ইসলামিরই নেতা ছিলেন, সেজন্যই এই ধারণার সূত্রপাত— একমাত্র জামায়াতে ইসলামিই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু একই কাজ করেছিল আরো অনেক রাজনৈতিক দল। এদের মধ্যে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লিগের তিন শাখা ও কৃষক-শ্রমিক পার্টি উল্লেখযোগ্য। অবিভক্ত পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর আওয়ামি লিগেরই অনেক নেতা তা বিশ্বাস করতে পারেননি বা মেনে নিতে পারেননি। ১৯৭০-এর নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের একশো ঊনসত্তর আসনের মধ্যে যে একশো সাতষট্টি আসন আওয়ামি লিগ পেয়েছিল, সেই একশো সাতষট্টিজনের সকলেই যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন; তা নয়। তাদের কেউ-কেউ বরং অখণ্ড পাকিস্তানই চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন ১৯৭০-এর নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী অবিভক্ত পাকিস্তানের শাসনক্ষমতার অংশীদার হতে। আওয়ামি লিগের এই একশো সাতষট্টি সাংসদের মধ্যে ক’জন অখণ্ড পাকিস্তান চেয়েছিলেন, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় ক’জন মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সক্রিয় সহযোগিতা করেছিলেন, ক’জন গণহত্যা সংঘটনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছিলেন; এর হদিস এখন আর পাওয়া যায় না। মুক্তিযুদ্ধের পরে তাদের কার কী পরিণতি হয়েছিল, তাও বিশদভাবে জানা যায় না। কালের গর্ভে তা গায়েব হয়ে গেছে বা গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। এটুকু জানা যায়— মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন দেওয়া আওয়ামি লিগের সাংসদদের সবাইকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদেরকেই সাংসদ হিশেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, ১৯৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত অবিভক্ত পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সদস্য ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রদেশিক পরিষদের সদস্যদের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেছিল।
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন মুসলিম লিগ-নেতা ডা. আবদুল মুতালিব মালেক। ঐ বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান সরকার ডা. মালেককে প্রধান করে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য চৌদ্দ সদস্য-বিশিষ্ট একটা মন্ত্রিসভা গঠন করে। সেই মন্ত্রিসভা পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র দাখিল করে ১৪ ডিসেম্বর। পদত্যাগের আগ পর্যন্ত তারা গণহত্যা পরিচালনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেন। আওয়ামি লিগের ঐ একশো সাতষট্টি প্রাদেশিক পরিষদসদস্যের মধ্য থেকে অন্তত দুজন সদস্য মালেক মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। তারা হলেন ওবায়দুল্লাহ মজুমদার ও শামসুল হক। অবশ্য চট্টগ্রামেরই আওয়ামি লিগ নেতা বখতিয়ারউদ্দিন চৌধুরী দাবি করেছেন— ‘চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের অধ্যাপক শামসুল হক আর ফেনীর সাংসদ প্রিন্সিপাল ওবায়দুল্লাহ মজুমদার আওয়ামি লিগের কর্মী ছিলেন না। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামি লিগের সাধারণ সম্পাদক এমএ আজিজের অনুরোধে বঙ্গবন্ধু তাদের মনোনয়ন দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু এমএ আজিজকে খুবই স্নেহ করতেন। এমএ আজিজ বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রভাব খাটাতে পারতেন। অধ্যাপক শামসুল হক আর চট্টগ্রামের পটিয়া কলেজের প্রিন্সিপাল ওবায়দুল্লাহ মজুমদার ছিলেন এমএ আজিজের ব্যক্তিগত বন্ধু।’ (২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, বাংলা ট্রিবিউন) তবে, উল্লিখিত দুই নেতা যে দলেরই হন না কেন, ইতিহাসে লেখা থাকবে— আওয়ামি লিগের মনোনয়নে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত দুই সাংসদ কুখ্যাত মালেক মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন।
১৯৭২ সালের দালাল আইনে যে সাঁইত্রিশ হাজার স্বাধীনতাবিরোধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাদেরও উল্লেখযোগ্য একটা অংশ আওয়ামি লিগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী ছিলেন। হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ— দালাল আদেশের আওতায় গ্রেপ্তারদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে এই চারটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল না, তাদের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান যে ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করেছিলেন বা করতে বাধ্য হয়েছিলেন; এর পেছনে অসংখ্য কারণ ছিল। বাংলাদেশী দোসরদের বিচার করা হলে পাকিস্তান সরকার একাত্তরে পাকিস্তানে আটকা-পড়া বাঙালিদেরকে ফেরত না দিয়ে বন্দি করে রাখবে, আটকে-পড়াদের মধ্যে যে বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করেছিলেন— তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে, বাঙালি সেনাকর্মকর্তার মধ্যে যারা পাকিস্তান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলেন— কোর্ট মার্শাল বসিয়ে তাদেরকেও বিচারের আওতায় আনা হবে, ‘গুপ্তচরবৃত্তি’র অভিযোগে বিচার করা হবে দুইশো পাঁচজন বাঙালি সেনাকর্মকর্তার; বাংলাদেশী দোসরদের একাংশের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণার বৃহত্তম কারণ ছিল এটি। আবদুল হামিদ খানের (ভাসানি) দল ন্যাপেরও অনেক নেতাকর্মী মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতা করে দালাল আইনে গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করছিলেন। ফলে, দালাল আইন বাতিলের দাবিতে তিনিও অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে দিয়েছিলেন, আমরণ অনশনের ডাক দিয়েছিলেন। আওয়ামি লিগ থেকে বেরিয়ে আসা নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলও (জাসদ) দালাল আইনের বিরোধী ছিল। ওদিকে আওয়ামি লিগের যে নেতারা মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতা করে দালাল আইনে জেল খাটছিলেন, তাদের মুক্তিযোদ্ধা আত্মীয়স্বজনরাও সরকারের কাছে তদবির চালিয়েছিলেন স্ব-স্ব স্বজনকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য বা শাস্তি কমিয়ে দেওয়ার জন্য। ফলে, ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা ছাড়া ত্যক্তবিরক্ত শেখ মুজিবুর রহমানের আর কিছুই করার ছিল না। ১৯৭৩ সালে ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণার পর আর একজনকেও দালাল আইনে গ্রেপ্তার করা হয়নি। মনে রাখতে হবে— স্বাধীনতাবিরোধীদের জন্য ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণার পেছনে যে একশো একটা কারণ আছে, এর মধ্যে অন্তত একটা কারণ ছিল কিছু আওয়ামি লিগ-নেতার তদবির।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে খোদ শেখ মুজিবুর রহমানও পর্যাপ্ত কঠোর হতে পারেননি বা হননি। মুক্তিযুদ্ধপূর্ববর্তী ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা রাজনৈতিক সহাবস্থানকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শন করেছিলেন। প্রত্যেক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী ব্যক্তিজীবনে ধনাঢ্য হওয়া সত্ত্বেও, দালাল আইনে কারাভোগরত কোনো-কোনো যুদ্ধাপরাধীর পরিবারকে শেখ মুজিবুর রহমান আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন। অবিভক্ত পাকিস্তানের সাবেক স্পিকার মুসলিম লিগ-নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী। মোহাম্মদ হাসন-সম্পাদিত, ডলফিন প্রকাশন-প্রকাশিত ‘ফজলুল কাদের চৌধুরী ও সমকালীন মুসলিমসমাজ’ বই থেকে জেনেছি— ‘ফজলুল কাদের চৌধুরী বিচারাধীন বন্দি হিশাবে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকাকালে ১৯৭২ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তার ছেলেদেরকে ধানমন্ডি ৩২-এর বাসায় ডেকে নিয়ে গিয়ে সস্নেহ প্রবোধ বাক্য সহকারে তাদেরকে আশ্বস্ত করেন, এমনকি টাকাপয়সার প্রয়োজন হলে চাইতেও বলেন।’ শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যাপারে ফজলুল কাদেরের মেজো ছেলে সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেছেন— ‘আমরা মাঝে-মাঝে তার কাছে যেতাম। ইদের সময়ে তিনি টাকা দিয়ে বলতেন কোরবানি দেওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় গরুটা কিনবি। তার কলিজাটা ছিল এত বড়। আমাদের শরীরে তো মুসলিম লিগের রক্ত, তাই শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কথা বলতে হয়।’ (সূত্র— বেলা-অবেলা, মহিউদ্দিন আহমদ)
আবদুল হামিদ খানের (ভাসানি) দল ন্যাপের শীর্ষ স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন মশিউর রহমান জাদু মিয়া। জাদু মিয়ার বড়ভাই সিধু মিয়া সর্দার ফজলুল করিম ও মুস্তাফা নুরুল ইসলামকে ১৯৮৫ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন— দেশ মুক্ত হওয়ার পর ১৯৭২ সালে জাদু মিয়া বাংলাদেশে আসেন। তখন আওয়ামি লিগের নেতারা শেখ মুজিবুর রহমানকে অনুরোধ করেছিলেন জাদু মিয়াকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিতে। কিন্তু দলের চাপ থাকা সত্ত্বেও জাদু মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। পরবর্তীকালে জাদু মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল একটা উক্তির কারণে— ‘আমি ক-দিনের মধ্যেই এই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারি।’ এই উক্তির পর জাদু মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, এর আগে নয়। সিধু মিয়ার দেওয়া তথ্যমতে— জাদু মিয়া ও শেখ মুজিবুর রহমান ‘ফার্স্ট ফ্রেন্ড’ ছিলেন। দু’জনের মুক্তিযুদ্ধপূর্ববর্তী সম্পর্ককে সিধু মিয়া ‘অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব’ বলে উল্লেখ করেছেন। সিধু জাদুকে বলেছিলেন— ‘তুমি ঢাকায় এসে বসে আছো কেন? তোমাকে নিয়ে তো কথাবার্তা হচ্ছে। তুমি একটু সরে থাকো।’ সিধু এ-কথা বলার সাথে-সাথে জাদু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফোন করেন এবং মুজিবকে বলেন— ‘তুই নাকি আমাকে অ্যারেস্ট করবি?’ ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা মুজিব কী বলেছিলেন, সিধু তা বলতে পারেননি। তবে, এটুকু জানিয়েছেন সেদিনকার ফোনালাপে মুজিব ও জাদুর মধ্যে হাসিঠাট্টা হয়েছিল। (সূত্র— বেলা-অবেলা, মহিউদ্দিন আহমদ)
খুলনার অন্যতম শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী ছিলেন মুসলিম লিগ-নেতা খান আবদুস সবুর। তিনি দালাল আইনে গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগও করছিলেন। কিন্তু তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করে চিঠি লিখতেই শেখ মুজিবুর রহমান তাৎক্ষণিকভাবে তার কারামুক্তির ব্যবস্থা করেন। দেশ টিভিতে আসাদুজ্জামান নুরকে (বাকের ভাই) দেওয়া সাক্ষাৎকারে (প্রচারকাল ১৫ ডিসেম্বর ২০২১) আওয়ামি লিগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেছেন— “সবুর খান জেলে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সাথে তো ভালো সম্পর্ক ছিল। সবুর খান চিঠি লিখছেন বঙ্গবন্ধুর কাছে— ‘যে বাংলার স্বপ্ন তুমি দেখেছিলে, মুজিব, সেই বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে যখন ভাবি— যে-বাংলার প্রধানমন্ত্রী আমারই প্রিয় শেখ মুজিব, সেই বাংলার বৃদ্ধ সবুর খান আজও কেন কারাগারে? আমি তার উত্তর খুঁজে পাই না, মুজিব।’ ব্যস, ইন্টারকমে আমাকে ফোন করল। আসো, আসলাম। কয়— চিঠিটা পড়ো। পড়লাম। আমারে জিজ্ঞেস করে— ‘হোয়াট ইজ ইয়োর রিঅ্যাকশন?’ আমি বললাম— ‘আমার তো মনে হয় আপনি এখনই ছেড়ে দেবেন।’ কয়— ‘ইয়েস। আই হ্যাভ ডিসাইডেড আই উইল রিলিজ হিম।’ তখন বঙ্গবন্ধু মশিউর রহমানকে ডাকলেন (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের তৎকালীন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থনীতি-বিষয়ক উপদেষ্টা)। মশিউর রহমান বললেন— ‘স্যার, ইচ্ছে করলেই তো ছাড়া যাবে না, আইনকানুনের ব্যাপার আছে।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘ফরগেট অ্যাবাউট ইট। বটম লাইন— হি উইল রিচ হিজ হাউজ টুনাইট।’ সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করল। জেলখানা থেকে সবুর খানরে আইন্না সবুর খানের ধানমন্ডি ২৫ নাম্বারের বাড়িতে পৌঁছায়া দেওয়া হইছে।” অর্থাৎ ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা পূর্বপরিচয়কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান একটা চিঠির প্রেক্ষিতে একজন যুদ্ধাপরাধীকেও কারামুক্ত করে দিয়েছিলেন, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়াও অবলম্বন করেননি।
দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত আরেক যুদ্ধাপরাধী শাহ্ আজিজুর রহমানও জেলে থাকাকালে তার পরিবারকে শেখ মুজিবুর রহমান আর্থিক সহায়তা পাঠাতেন। তোফায়েল আহমেদেরই মাধ্যমে মুজিব আজিজের পরিবারকে মাসে সাত হাজার টাকা করে পাঠাতেন। আজিজ ১৯৭৩ সালে ‘সাধারণ ক্ষমা’র আওতায় কারামুক্ত হওয়ার পর মুজিব তাকে বাইশ হাজার টাকা দামের ‘ভিভা ভক্সহল’ গাড়িও উপহার দিয়েছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের সহকারী একান্ত সচিব শাহরিয়ার ইকবালের বর্ণনা থেকে জানা যায়— ১৯৭৫ সালের ১৯ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজে শেখ মুজিব শাহ্ আজিজকে অতিথি হিশেবে উপস্থিত রেখেছিলেন, উপস্থিত রেখেছিলেন দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত আরো একজনকে, নাম জহিরউদ্দিন। শাহ্ আজিজকে শেখ মুজিব পাকিস্তানে রাষ্ট্রদূত করে পাঠানোরও পরিকল্পনা করেছিলেন। ‘সময়-অসময়’ বইয়ে মহিউদ্দিন আহমদ এই তথ্যগুলো উল্লেখ করেছেন। তথ্যগুলো তিনি নিয়েছেন শাহরিয়ার ইকবালের স্মৃতিচারণমূলক লেখা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব : কাছে থেকে দেখা’ থেকে।
শীর্ষ স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতি প্রদর্শিত শেখ মুজিবুর রহমানের এই নমনীয় আচরণকে দুইভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়। একে, প্রথমত, মহানুভবতা হিশেবেই উপস্থাপন করা যায়। সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল সেই দেশগুলোর স্বীকৃতি, যেসব দেশ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিল। সেই স্বীকৃতি আদায় করতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশে-বিদেশে বিভিন্নভাবে সমঝোতা করতে হয়েছে। পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য হলেও দেশী যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি তাকে নমনীয় হতে হয়েছে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে কোনো-কোনো স্বাধীনতাবিরোধীর বাড়িতে তিনি মাসে-মাসে টাকা পাঠিয়েছেন, চিঠি পেয়েই কারামুক্তির ব্যবস্থা করেছেন, গাড়ি উপহার দিয়েছেন। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবলে এই উদারতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। শেখ মুজিব বিরুদ্ধমতের আরো অনেককেই গোপনে টাকাপয়সা দিতেন। বিরোধীদলের নেতা আবদুল হামিদ খানকে টাকা-লুঙ্গি-গামছা পাঠাতেন। এই আচরণ নিঃসন্দেহে মুজিবের উত্তুঙ্গ উদার মনের পরিচয় বহন করে। মুজিব কেবল আওয়ামি লিগের প্রধানমন্ত্রী না হয়ে গোটা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়তে দল-মত নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন সদ্যস্বাধীন দেশে কোনো বিভক্তি না রাখতে।
কিন্তু এটাও অনস্বীকার্য— মুজিব ব্যক্তিগত সম্পর্ককে আইনেরও ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে ফেলেছিলেন। সামান্য এক চিঠির প্রেক্ষিতে, আইনি প্রক্রিয়ার ধার না-ধেরে একজন প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধীকে তাৎক্ষণিকভাবে কারাগার থেকে বের করে বাসায় পৌঁছে দেওয়া নিশ্চয়ই রাষ্ট্রের জন্য সুখকর দৃষ্টান্ত না। দলের নেতারা গ্রেপ্তারের জন্য চাপ দেওয়া সত্ত্বেও সেরেফ ব্যক্তিগত সম্পর্কের জন্য আরেক যুদ্ধাপরাধীকে (জাদু মিয়া) গ্রেপ্তারের নির্দেশ না-দেওয়া— এও দুর্বল দৃষ্টান্তের উদাহরণ। ফজলুল কাদের চৌধুরী, শাহ্ আজিজুর রহমান— দু’জনই অত্যন্ত ধনাঢ্য ব্যক্তি। চট্টগ্রামে কাদের-পরিবারের সহায়সম্পত্তির পরিমাণ রীতিমতো কিংবদন্তিতুল্য। যুদ্ধাপরাধী হওয়া সত্ত্বেও এত সম্পদশালী পরিবারগুলোকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অনুদান দেওয়ার খবর বা গাড়ি উপহার দেওয়ার সংবাদ নিশ্চয়ই শহিদ পরিবারগুলোকে স্বস্তি দেয়নি। শাহ্ আজিজুর রহমানকে পাকিস্তানে রাষ্ট্রদূত করে পাঠানোর সিদ্ধান্তকেও আত্মঘাতীই বলতে হবে। অন্য রাষ্ট্রে, তা যে রাষ্ট্রেই হোক, স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিশেবে পাঠানো হবে একজন চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধীকে, একজন সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীকে— মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এও নিশ্চয়ই অসহ্য রকমের পীড়াদায়ক হতো। এমন না যে, শেখ মুজিবুর রহমান কোনো স্বাধীনতাবিরোধীকে দলের শীর্ষপদে জায়গা দিয়েছেন বা নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়ে পরে মন্ত্রী বানিয়েছেন। কিন্তু মাত্রই স্বাধীন হওয়া দেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতি এমন শিথিল আচরণ দেশের মঙ্গল বয়ে আনেনি, মঙ্গল বয়ে আনেনি আওয়ামি লিগ বা ব্যক্তি মুজিবের জন্যও।
ফজলুল কাদের চৌধুরীর যে ছেলেদের হাতে টাকা দিয়ে কোরবানির জন্য শেখ মুজিবুর রহমান সবচেয়ে বড় গরুটা কিনতে বলেছিলেন, সেই ছেলেদেরই একজন— সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী আমৃত্যু মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে গেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেছেন। সালাউদ্দিন শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘শেমু রহমান’ বলে সম্বোধন করতেন। আওয়ামি লিগের লোকজন সবকিছুতেই ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন’ খুঁজে পায় দেখে ১৯৯৬ সালে ফেনীর এক জনসভায় খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে সালাউদ্দিন বলেছিলেন— ‘বঙ্গবন্ধু এত বেশি স্বপ্ন দেখতেন যে, মনে হয় ওনার স্বপ্নদোষ আছিল।’ কাদের-পরিবারের প্রতি প্রদর্শিত শেখ মুজিবুর রহমানের অনুগ্রহের প্রতিদান ফজলুল কাদেরের ছেলে সালাউদ্দিন কাদের এভাবেই দিয়েছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের আরেক প্রিয়পাত্র তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার বড় ছেলে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনও মুক্তিযুদ্ধে প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা পালন করেছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের ইত্তেফাক অফিস গুঁড়িয়ে দিলেও মইনুল হোসেন পাকিস্তান সরকারের সাথে দেনদরবার করে ক্ষতিপূরণ আদায় করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই ইত্তেফাক ফের চালু করে পাকিস্তানের স্বার্থ বাস্তবায়ন করেছেন। সবকিছু জেনেও শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে মইনুল হোসেনকে আওয়ামি লিগ থেকে মনোনয়ন দিয়েছেন। পরবর্তীকালে মইনুল হোসেন খন্দকার মোশতাক আহমেদের ডেমোক্রেটিক লিগে যোগ দিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের ঔদার্যের প্রতিদান মইনুল হোসেনও এভাবেই দিয়েছিলেন।
দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত যে শাহ্ আজিজকে শেখ মুজিব অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর নৈশভোজে অতিথি করেছিলেন, পাকিস্তানে রাষ্ট্রদূত করে পাঠানোর পরিকল্পনা করেছিলেন, গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন; সেই শাহ্ আজিজ ‘সাধারণ ক্ষমা’ পেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশেও বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছিলেন এবং এই অপরাধে ১৯৭৪ সালের ১০ মে মাসে আবারও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। শুনলে এখন অবিশ্বাস্য মনে হবে— শাহ্ আজিজ মুক্তিযুদ্ধে নিহত রেজাকার-আলবদরদের পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য প্রকাশ্যে দাবি তুলেছিলেন, দালাল আইনে গ্রেপ্তার সব স্বাধীনতাবিরোধীর মুক্তি দাবি করেছিলেন, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ বিদেশে পালিয়ে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের (যেমন গোলাম আজম) নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি করেছিলেন। অর্থাৎ নিজে ‘সাধারণ ক্ষমা’ পেয়ে ও শেখ মুজিবুর রহমানের অনুগ্রহভাজন হয়ে লাইয়ে-লাইয়ে মাথায় চেপে বসেছিলেন। শাহ্ আজিজ এভাবেই শেখ মুজিবের আশকারার প্রতিদান দিয়েছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ হত্যাকারীরা যাকে (জিয়া) সেনাপ্রধান বানিয়েছিল, শাহ্ আজিজ সেই জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন এবং একপর্যায়ে জিয়ার প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। আজিজ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করে কোনো মুসলমান কবির লেখা গান জাতীয় সংগীত বানানোর জন্যও জিয়াউর রহমানকে চিঠি দিয়েছিলেন। অর্থাৎ আজিজ আমৃত্যু বাংলাদেশবিরোধী ছিলেন।
মশিউর রহমান জাদু মিয়া দালাল আইনের মামলা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন ১৯৭৪ সালে। শেখ মুজিবুর রহমানেরই জীবদ্দশায় ১৯৭৪ সালেই তিনি আবারও গ্রেপ্তার হন, মুক্তি পান ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে। তিনি দ্বিতীয়বার কেন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, হদিস পাইনি। গণভোট নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দেওয়ায় জিয়াউর রহমান জাদুকে ১৯৭৭ সালে গৃহবন্দি করেছিলেন, জাদুর ছেলেদেরকে গ্রেপ্তার করিয়েছিলেন। অভিযোগ আনা হয়েছিল— জাদু মিয়ার ছেলেরা জিয়াউর রহমানের গণভোটের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেছেন। এই হাস্যকর অভিযোগে তাদেরকে তিন সপ্তাহ জেলে পুরে রাখা হয়, তারা ছাড়া পেয়েছিলেন গণভোট শেষ হয়ে যাওয়ার পরে। এই জাদুই পরে জিয়াউর রহমানের ‘সিনিয়র মিনিস্টার’ হয়েছিলেন (পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর সমান), বিএনপি-প্রতিষ্ঠায় জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন এবং জিয়াউর রহমানকে সেনাশাসক থেকে রাজনৈতিক নেতা বানিয়েছিলেন। অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমান যেসব স্বাধীনতাবিরোধীদেরকে অনুকম্পা প্রদর্শন করেছিলেন, তাদের কেউই পরবর্তীকালে মুজিবের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেননি, উলটো বিদ্রুপ করেছেন অথবা মুজিবের হত্যাকারীদের বানানো সেনাপ্রধানের সাথে যোগ দিয়েছেন।
এ-কথা সর্বজনবিদিত যে, মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ না করে ছদ্মবেশে পাকিস্তানের পক্ষেই কাজ করেছেন। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী হতে না পারার ক্ষোভও তার মধ্যে ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়ে তিনি তাজউদ্দিনবিরোধী অপপ্রচারে লিপ্ত ছিলেন। তিনি প্রচার করতে থাকেন— তাজউদ্দিন অবৈধভাবে নিজেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা তার (তাজ) নেই, দুর্বল নেতৃত্বের কারণে মুক্তিযুদ্ধ ঝিমিয়ে পড়েছে। একাত্তরে ইউএসএর পরিকল্পনা ছিল স্বায়ত্তশাসনের প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশকে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখা এবং এভাবে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করা। ইউএসএ এই গোপন প্রক্রিয়ায় দু’জনকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল— পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাককে আর পররাষ্ট্রসচিব মাহবুব আলম চাষিকে। কথা ছিল সেপ্টেম্বরে মোশতাক ইউএসএ গিয়ে ছয়দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে বক্তৃতা করবেন। কিন্তু অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ব্যাপারটা জেনে যান, মোশতাককে ইউএসএ পাঠানো থেকে বিরত থাকেন এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে ইউএসএগামী প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বের দায়িত্ব দেন তথ্যসূত্র— (স্বৈরশাসনের নয় বছর ১৯৮২-৯০, মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি)।
খন্দকার মোশতাকের স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্র সুস্পষ্ট। তিনি বরাবরই পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখতে চেয়েছেন, মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রিত্ব চেয়েছেন। ইউএসএ ও পাকিস্তানের সাথে মোশতাকের ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে মুজিবনগর সরকার মোশতাককে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে নিষ্ক্রিয় করে রাখে, তার পরিবর্তে অঘোষিতভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন আবদুস সামাদ আজাদ। সবকিছু জেনেও স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমান খন্দকার মোশতাককেই সবচেয়ে কাছে টেনেছিলেন এবং সপরিবার খুনের শিকার হয়ে এই শোচনীয় ভুলের মাশুল গুনেছিলেন। যদি ধরে নেওয়া হয়— মুজিব মোশতাকের মুক্তিযুদ্ধকালীন কর্মকাণ্ডের কথা জানতেন না, তা হলেও বলতে হয়— মুজিবের উচিত ছিল তাজউদ্দিন-নজরুলদের কাছ থেকে সবকিছু জেনে নেওয়া। মুজিব বরাবরই ভুল মানুষদেরকে অনুকম্পা প্রদর্শন করেছেন, বিশ্বাসঘাতকদেরকে পাশে রেখে বিশ্বস্তদের সাথে দূরত্ব তৈরি করেছেন। পরবর্তীকালে মোশতাকের হাত ধরেই বাংলাদেশে পাকিস্তানি ভাবধারার পুনঃপ্রচলন শুরু হয়েছিল এবং সেই ধারা অদ্যাবধি অব্যাহত আছে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রায় পুরোটা সময় পাকিস্তানে ছিলেন, অসুস্থ বাবাকে দেখতে বা অবকাশ যাপন করতে কয়েকবার রংপুরে এসেছেন। কিন্তু তিনি কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানোর জন্য রংপুরের মুক্তিযোদ্ধারা শহিদ মুখতার ইলাহির নেতৃত্বে এরশাদের সাথে দেখা করার চেষ্টা করলে এরশাদ দেখা পর্যন্ত দেননি। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বাঙালি সেনাকর্মকর্তাদের বিচারের জন্য পাকিস্তানে যে ট্রাইবুনাল গঠিত হয়েছিল, এরশাদ ছিলেন সেই ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি এরশাদের নিরঙ্কুশ আনুগত্য না থাকলে পাকিস্তান সরকার নিশ্চয়ই এরশাদকে এই দায়িত্ব দিত না। ১৯৭৩ সালে এরশাদ বাংলাদেশে ফিরে এসে দেখেন সেনাবাহিনীতে তার চাকরি নেই। বাংলাদেশে এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যেসব বাঙালি সেনাকর্মকর্তা স্বেচ্ছায় পাকিস্তানেই থেকে গিয়েছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে তাদেরকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এরশাদ ছিলেন তাদেরই একজন। মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসির ভাষ্যমতে— ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এরশাদ বাংলাদেশে ফেরত আসেন এবং চাকরি ফিরে পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী ও কুড়িগ্রামের আওয়ামি লিগ-নেতা রিয়াজউদ্দিন মিয়া একদিন সন্ধ্যায় এরশাদকে পাজামা-পাঞ্জাবি পরিয়ে এর ওপর একটি মুজিব কোট পরিয়ে তার হয়ে তদবিরের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন— আমার ভাগনের চাকরিটা না থাকলে যুদ্ধ করে আমার কী লাভ হলো! এ কথা বলার সাথে-সাথে এরশাদ শেখ মুজিবের পা ছুঁয়ে সালাম করেন। শেখ মুজিব এতে খুশি হয়ে তাকে চাকরিতে বহাল রাখার নির্দেশ দেন।’ এরশাদকে চাকরিতে বহাল রাখার জন্য উপ-সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে সুপারিশ করেছিলেন।
রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর এরশাদ বেশকিছু যুদ্ধাপরাধীকে মন্ত্রিত্ব দিয়েছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের স্বঘোষিত খুনিদেরকে দেশে ফিরিয়ে এনে তাদেরকে দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করিয়েছেন, মুজিবের খুনি সৈয়দ ফারুক রহমানকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছেন, মুজিবের দুই খুনিকে নির্বাচনে জিতিয়ে এনে জাতীয় সংসদে আসীন হওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলেন। যে শেখ মুজিবুর রহমানের পা ধরে এরশাদ নিজের চাকরি বাঁচিয়েছিলেন, এরশাদ সেই শেখ মুজিবুর রহমানের উদারতার প্রতিদান এভাবেই দিয়েছিলেন। জিয়াহত্যার পেছনেও এরশাদের সুস্পষ্ট ভূমিকা আছে। রাজনীতির নির্মম পরিহাস হলো— আওয়ামি লিগ-বিএনপি দুই দলই পরবর্তীকালে এরশাদকে নিজ-নিজ নির্বাচনী জোটে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এরশাদের পদলেহন করেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের পুনর্বাসন করা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে মন্ত্রী পদমর্যাদায় নিজের ‘বিশেষ দূত’ হিশেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ স্বাধীনতাবিরোধী এরশাদের পুনর্বাসনে ভূমিকা রেখেছেন শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা— সবাই। উদারচিত্ত শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন এরশাদের মামার আবদার উপেক্ষা করলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে এরশাদের মতো একজন বিশ্ববেহায়াকে দেখতে হতো না। উল্লেখ্য এরশাদকে বিশ্ববেহায়া খেতাব দিয়েছিলেন চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইশুতে নব্বইয়ের দশকে আওয়ামি লিগ জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধ আন্দোলন করেছিল মর্মে বাংলাদেশের বিভিন্ন মহলে জোর আলোচনা আছে। অবশ্য আওয়ামি লিগ ও জামায়াত আনুষ্ঠানিকভাবে কখনও জোট গড়ে তোলেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আওয়ামি লিগেরও ছিল, জামায়াতেরও ছিল, ফলে নব্বইয়ের দশকে এই দুই দলের কিছু রাজনৈতিক বক্তব্য মিলে গিয়েছিল— আওয়ামি লিগের তরফ থেকে সংক্ষেপে এ রকম দাবি করা হয়ে থাকে। কিন্তু ইন্টারনেটে ১৯৯৪ সালের জুন মাসের একটা ছবি প্রায়ই ভেসে বেড়ায়; যে ছবিতে পাশাপাশি বসে সাংবাদিকসম্মেলন করছেন শেখ হাসিনা, সাজেদা চৌধুরী, মওদুদ আহমদ আর মতিউর রহমান নিজামী। সেই সাংবাদিকসম্মেলন কী উপলক্ষে ছিল, কী বলা হয়েছিল সেখানে— তা অবশ্য নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। কোথাও দেখেছি সাংবাদিকসম্মেলনটা জাতীয় সংসদে হয়েছিল, কোথাও দেখেছি প্রেসক্লাবে।
সেই সাংবাদিকসম্মেলনের আগে-পরে জামায়াতের সাথে আওয়ামি লিগের কী সম্পর্ক ছিল, তাও স্পষ্ট জানা যায় না। আওয়ামি লিগের তরফ থেকে সেই ছবির কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় না। ছবিটা সম্ভবত বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের মতো ব্যাখ্যাতীত। কেউ-কেউ বলেন নিজামী সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন না, চেয়ার খালি পেয়ে হুট করে বসে পড়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামি লিগের সভাপতির সাংবাদিকসম্মেলনে কারো যে হুট করে বসার সুযোগ নেই, তাও আবার নিজামীর মতো একজন যুদ্ধাপরাধীর— হুটতত্ত্বের প্রবক্তারা তা ভুলে যান। আওয়ামি লিগ ছবিটাকে ইতিহাস থেকে মুছে দিতে চাইবে, যথাসম্ভব অস্বীকার করতে চাইবে। কিন্তু সাংবাদিকসম্মেলন যে উপলক্ষেই হোক, সেখানে যা-ই বলা হোক; ইতিহাসে ছবিটা খোদাই হয়ে থাকবে, ইতিহাসে লেখা থাকবে— আওয়ামি লিগ সভাপতি শেখ হাসিনা আর আল-বদরনেতা মতিউর রহমান নিজামী অন্তত একবার পাশাপাশি বসে সাংবাদিকসম্মেলন করেছেন। এক টেবিলে শেখ হাসিনা আর নিজামীর সাংবাদিকসম্মেলন হতে পারে কি না, ইতিহাসই এর উত্তর দেবে। আলোচ্য সাংবাদিকসম্মেলনে উপস্থিত থাকা সাজেদা চৌধুরী মারা গেছেন ২০২২ সালে, মওদুদ আহমদ ২০২১ সালে। নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে ২০১৬ সালে। বেঁচে আছেন কেবল শেখ হাসিনা। সাজেদা, মওদুদ বা নিজামীর মৃত্যুর মধ্য দিয়েই ইতিহাস মরে যায়নি। ইতিহাস আরো অবশিষ্ট আছে।
মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আজমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন— ‘১৯৮০-এর দশকে এবং ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে এবং ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে বিএনপির বিরুদ্ধে জামায়াত ও আওয়ামি লিগ যুগপৎ আন্দোলন করেছিল, তখন কোনোদিন আওয়ালি লিগ জামায়াত নেতৃবৃন্দকে যুদ্ধাপরাধী মনে করেনি। ফেব্রুয়ারি ১৯৯১-এর নির্বাচনের পর সরকারগঠনের জন্য আওয়ালি লিগ জামায়াতের সহযোগিতা প্রার্থনা করে আমার নিকট ধরনা দিয়েছিল, আওয়ামি লিগের নেতা আমির হোসেন আমু সাহেব জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদ সাহেবের মাধ্যমে আমাকে মন্ত্রী বানানোর প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। তখনও আওয়ামি লিগের মনে হয়নি জামায়াতে ইসলামি যুদ্ধাপরাধী। পরবর্তীকালে আওয়ামি লিগ মনোনীত প্রেসিডেন্টপদপ্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী জামায়াতের সমর্থন লাভের আবদার নিয়ে যখন আমার সাথে সাক্ষাৎ করেন, তখনও তাদের দৃষ্টিতে জামায়াত নেতৃবৃন্দ যুদ্ধাপরাধী ছিল না।’
আলোচ্য রাষ্ট্রপতি-নির্বাচনে জামায়াতের সাংসদরা ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। বিএনপির প্রার্থী আবদুর রহমান বিশ্বাস (স্বাধীনতাবিরোধী) পেয়েছিলেন একশো বাহাত্তর ভোট আর আওয়ামি লিগের বদরুল হায়দার পেয়েছিলেন বিরানব্বই ভোট। ফলে, জামায়াতের সাংসদরা বদরুল হায়দারকে ভোট দিলে বদরুল তাতেও জয়ী হতেন না। যা হোক, ১৯৯১-এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামি লিগের প্রার্থী বদরুল হায়দার জামায়াতের বিশ সাংসদের সমর্থন লাভের আশায় গোলাম আজমের সাথে দেখা করেছিলেন— এই তথ্য সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ১৯৯১-এর নির্বাচনের পর আওয়ামি লিগ সরকারগঠনের উদ্দেশ্যে জামায়াতের সহযোগিতা চেয়েছিল, গোলাম আজমকে মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দিয়েছিল— এই তথ্য কখনও তেমন একটা আলোচিত হতে দেখা যায় না। আওয়ামি লিগ আজমের এই বক্তব্যের কোনো প্রতিবাদও করেনি, দাবি করেনি— আমু মুজাহিদের মাধ্যমে গোলাম আজমকে মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দেয়নি। আজমের এই দাবি সত্য হয়ে থাকলে, অর্থাৎ ১৯৯১-এর নির্বাচনের পর আওয়ামি লিগ সরকারগঠনের উদ্দেশ্যে জামায়াতের সহযোগিতা চেয়ে থাকলে আওয়ামি লিগের গোটা রাজনীতিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে, প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে জামায়াতের সাথে জোট গঠনের অপরাধে বিএনপিকে দোষারোপ করা।
জামায়াতের সাথে কখনও আনুষ্ঠানিক জোট না হলেও আওয়ামি লিগ ধর্মভিত্তিক আরেক রাজনৈতিক দল খেলাফতে মজলিশের সাথে নির্বাচনী জোট গঠন করেছিল। ২০০৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর আওয়ামি লিগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল খেলাফত মজলিশের তৎকালীন আমির আজিজুল হকের সঙ্গে পাঁচদফা সমঝোতাস্মারক সই করেন। দফাগুলো হলো আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় গেলে শরিয়তবিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করবে না, কওমি মাদ্রাসার সনদের সরকারি স্বীকৃতি দেবে, সনদপ্রাপ্ত ‘হক্কানি’ আলেমদেরকে ফতোয়া জারির সুযোগ দেবে, নবি-রাসুল ও সাহাবিদের সমালোচনাকে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য করে আইন প্রণয়ন করবে (অর্থাৎ ব্লাসফেমি আইন পাশ করবে) এবং হজরত মুহাম্মদকে (সা) সর্বশেষ নবি বলে ঘোষণা করবে (অর্থাৎ কাদিয়ানিদেরকে অমুসলমান বলে রায় দেবে)। তীব্র সমালোচনার মুখে আওয়ামি লিগ অবশ্য এই চুক্তি বাতিল করেছিল।
কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না— খেলাফত মজলিশের এই আজিজুল হক একজন স্বঘোষিত স্বাধীনতাবিরোধী। ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল আজিজের সাক্ষাৎকার। সেখানে তিনি বলেছিলেন— ‘একাত্তরে আমগো অবস্থান ছিল নিরপেক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে। আমরা কখনোই চাই নাই পাকিস্তান ভাইঙ্গা বাংলাদেশ স্বাধীন হোক।’ আজিজ স্বাধীন বাংলাদেশেও ধর্মীয় উগ্রবাদ ও পশ্চাৎপদতা বিস্তারে ভূমিকা পালন করেছেন, ১৯৯২ সালে ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনায় তিনি বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলা উসকে দিতে চেয়েছিলেন। তার ছেলে মামুনুল হকও ওয়াজ মাহফিলে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টিতে সিদ্ধহস্ত। ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের তাণ্ডবের অন্যতম কারিগর মামুন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পূর্তি উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলাম ২০২১ সালের মার্চে দেশজুড়ে যে আরেক দফা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল, মামুন সেটিরও অন্যতম রূপকার। মামুনই শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ছুড়ে ফেলার হুমকি দিয়েছেন।
আরো মনে রাখতে হবে— আলোচ্য চুক্তি সম্পাদনকালে খেলাফতের নায়েবে আমির ছিলেন মোহাম্মদ ইসহাক। এই লেখায়ই যে মুক্তিযুদ্ধকালীন মালেক মন্ত্রিসভার কথা উল্লেখ করেছি (যে মন্ত্রিসভার সদস্যরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছিলেন গণহত্যা সংঘটনে), এই ইসহাক ছিলেন সেই মালেক মন্ত্রিসভারই একজন মন্ত্রী। আরো সাত মন্ত্রীর সাথে ইসহাকও ১৯৭১ সালের ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন এবং পরবর্তীকালে দালাল আইনে জেল খাটেন। ঐ ইসহাকই বর্তমানে খেলাফতের আমির। দেখা যাচ্ছে— আওয়ামি লিগের সাথে চুক্তি সম্পাদনকালে যিনি খেলাফতের আমির ছিলেন, তিনিও স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন; যিনি বর্তমানে খেলাফত-আমির, তিনি রীতিমতো দালাল আইনে জেল খাটা স্বাধীনতাবিরোধী। অর্থাৎ আওয়ামি লিগও স্বাধীনবিরোধীদের সাথে জোট করেছিল এবং তা খুব বেশি আগের কথা না, মাত্র ২০০৬ সালের কথা। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি যে নির্বাচনটা হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি, সেই নির্বাচনটা তখন হয়ে গেলে খেলাফতের সাথে আওয়ামি লিগের আলোচ্য চুক্তিটাও বহাল থাকত এবং নির্বাচনের পর আওয়ামি লিগ খেলাফতকে হয়তো একটা মন্ত্রিত্বও দিত, তখন দেখা যেত স্বাধীনতাবিরোধী আজিজ বা ইসহাকের গাড়িতে উড়ছে আওয়ামি লিগ-প্রদত্ত জাতীয় পতাকা।
বামপন্থিদের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সশস্ত্র বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের ভেতর উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন কমরেড মোহাম্মদ তোয়াহা। তিনি মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করেছেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করেছেন; মুক্তিযুদ্ধকে তিনি মনে করতেন ‘দুই কুকুরের লড়াই’। স্বাধীন বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলেও তিনি পালিয়ে যান, ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে পরোয়ানা প্রত্যাহার হওয়ার পর ফের দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন এবং ব্রিটিশ আমলে মাস্টারদা সূর্যসেনের সাথে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুট করা কনিষ্ঠ সদস্য সুখেন্দু দস্তিদারের সাথে মিলিত হয়ে ‘বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল’ গঠন করেন। অর্থাৎ সাম্যবাদী দল গঠনের পেছনে জড়িয়ে আছেন একজন স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তি, যিনি যুদ্ধাপরাধ মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে পালিয়ে ছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামি লিগ যে চৌদ্দদলীয় মহাজোট গঠন করেছিল, এই সাম্যবাদী দল সেই চৌদ্দ দলের এক দল। ঐ নির্বাচনের পর সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়াকে আওয়ামি লিগ শিল্পমন্ত্রী বানিয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধকালে দিলীপ বড়ুয়ার ভূমিকা কী ছিল, খুঁজে পাইনি; তবে, ‘বাংলা ইনসাইডার’ নামক একটি আওয়ামি লিগ-পন্থি অনলাইন পত্রিকা ২০২০ সালের ৬ মার্চ উল্লেখ করেছে দিলীপও মুক্তিযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের লড়াই’ মনে করতেন এবং শুরুর দিকে তার রাজনৈতিক জীবনের মূল মন্ত্র ছিল আওয়ামি লিগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের বিরোধিতা (উল্লেখ করে রাখা প্রয়োজন— ‘বাংলা ইনসাইডার’ নির্ভরযোগ্য কোনো পত্রিকা না)। মুক্তিযুদ্ধে দিলীপ বড়ুয়ার ভূমিকা খুঁজতে গিয়ে দেখলাম বাংলা নিউজ পত্রিকা ২০২৩ সালের ১২ আগস্ট দিলীপ বড়ুয়ার একটা বক্তব্য প্রকাশ করেছে। শোকদিবসের আলোচনাসভায় প্রেসক্লাবে দিলীপ বলেছেন—’আমরা ষাটের দশকে আন্দোলন করেছি, সত্তরের দশকে আন্দোলন করেছি, ৭ মার্চের ভাষণ শুনেছি। এজন্য এ কথা বলতে পারি— যারা মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করে না, তারা বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করতে পারে; কোনো বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করতে পারে না।’ দিলীপ ৭ মার্চের ভাষণ শোনার কথা শুনিয়েই থেমে গিয়েছেন, আর সামনে এগোননি, বলেননি— যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। এখান থেকে অনুমান করা যায়— নিজের মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকার কথা তিনি এখন আর খোলাসা করতে চান না, ৭ মার্চ পর্যন্তই সই।
যা হোক, সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টির বরাত দিয়ে ‘প্রথম আলো’ ২০১১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ‘দিলীপ বড়ুয়া যে কারণে মন্ত্রী’ শিরোনামে লিখেছে— ‘শেখ হাসিনা তার কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষেত্রে দিলীপ বড়ুয়াকে কম হুমকি বলে মনে করেছিলেন। এ কারণেই বাম রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাকে বাদ দিয়ে তিনি দিলীপ বড়ুয়াকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন। উইকিলিকস এই তারবার্তাটি ফাঁস করে।’ উল্লেখ্য ২০০৮ সালের নির্বাচনে দিলীপ অংশগ্রহণ করেননি এবং আওয়ামি লিগ তাকে মন্ত্রী বানিয়েছিল টেকনোক্র্যাট কোটায়। দিলীপ বড়ুয়া স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন কি না— নিশ্চিত না। কিন্তু তার দলের প্রতিষ্ঠাতা (তোয়াহা) সশস্ত্র স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন। একজন স্বাধীনতাবিরোধীর প্রতিষ্ঠিত দলের সঙ্গে আওয়ামি লিগ কেন জোট করল, কেন সেই দলের সাধারণ সম্পাদককে মন্ত্রিত্ব দিল, দলটাকে রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার করল— আওয়ামি লিগকে কেউ এই প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে বলে অদ্যাবধি শুনিনি।
আওয়ামি লিগ যে কখনোই কোনো স্বাধীনতাবিরোধীর গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেয়নি, অর্থাৎ কোনো স্বাধীনতাবিরোধীকে মন্ত্রী করেনি; তা নয়। আওয়ামি লিগ অন্তত দুজন স্বাধীনতাবিরোধীকে মন্ত্রী বানিয়েছে। শেখ হাসিনার প্রথম মন্ত্রিসভার ধর্মপ্রতিমন্ত্রী ছিলেন নুরুল ইসলাম। জামালপুরের এই নেতা ১৯৯৬-এর নির্বাচনে বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুস সালাম তালুকদারকে পরাজিত করে পুরস্কার হিশেবে মন্ত্রিত্ব পেয়েছিলেন। তিনি একাত্তরে রেজাকার ছিলেন বলে শক্ত অভিযোগ আছে; যদিও জীবদ্দশায় তিনি নিজেও তা কখনও স্বীকার করেনি, আওয়ামি লিগও স্বীকার করে না। ২০০১-এর নির্বাচনের আগে সরিষাবাড়ি উপজেলা আওয়ামি লিগ সাংবাদিকসম্মেলন ডাকতে বাধ্য হয়েছিল, ব্যাখ্যা করতে বাধ্য হয়েছিল নুরুল ইসলামের মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা। উপজেলা আওয়ামি লিগ ঐ সাংবাদিকসম্মেলনে সাফাই গেয়েছিল এই মর্মে— নুরুল ইসলাম একাত্তরে রেজাকার ছিলেন কি না, তা স্পষ্ট না। সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় সাধারণত সব মন্ত্রী-সাংসদের জানাজা হলেও সেখানে নুরুল ইসলামের জানাজা হয়নি, মুক্তিযোদ্ধাদের আপত্তির মুখে ঐ জানাজা বাতিল হয়েছিল মর্মে উইকিপিডিয়ায় তথ্য পেয়েছিলাম। তথ্যসূত্র হিশেবে উইকিপিডিয়ায় যে দুটো পত্রিকার লিংক সংযুক্ত ছিল, তা এখন ‘স্থায়ীভাবে অকার্যকর’ দেখাচ্ছে।
যে দুজনকে আমাদের জাতিসত্তার উন্মেষের অন্যতম স্থপতি বলে ধরা হয়, অবিশ্বাস্য ব্যাপার হচ্ছে— সেই আবুল কাশেম ফজলুল হক (শের-এ-বাংলা) ও হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দির সন্তানরাও মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকবাহিনীর গণহত্যাকে সমর্থন করেছিলেন। সোহরাওয়ার্দির মেয়ে বেগম আখতার সোলায়মান যে কেবল মুখে-মুখে স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন, তা না। একাত্তরে আওয়ামি লিগের যেসব নেতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি, আখতার তাদেরকে নিয়ে আলাদা একটা রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন; এমনকি রেজাকারবাহিনীর আদলে আরেকটা ‘স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী’ গড়তে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ এক রেজাকারবাহিনী দিয়ে তার পোষাচ্ছিল না, তার আরো রেজাকার লাগবে। স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন আবুল কাশেম ফজলুল হকের মেয়ে রইসি বেগমও। ১৯৭১ সালের ২ মে তিনি বলেন— ‘(১৯৭১ সালের) ২৬ মার্চ আমাদের সাত কোটি পূর্ব পাকিস্তানির জন্য মুক্তির দিন। এ দিনে আমরা এক উগ্র মতবাদ থেকে মুক্তিলাভ করেছি। এ মতবাদ ইসলাম ও পাকিস্তানি আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। পাক সীমান্তের অপর পারের সংঘবদ্ধ সাহায্যপুষ্ট ও প্ররোচিত মুষ্টিমেয় দেশদ্রোহীর দ্বারা আমরা সন্ত্রস্ত ও ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছিলাম। কিন্তু, আলহামদুলিল্লাহ, নির্যাতিত অসংখ্য মুসলমানের প্রার্থনা আল্লাহ শুনেছেন এবং পাকিস্তানকে আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের সাত কোটি মানুষের পক্ষে আমি আমাদের অদম্য সশস্ত্র বাহিনীর বীর সেনানীদেরকে সালাম জানাই।’ রইসি বেগম আরো বলেন— ‘আলহামদুলিল্লাহ, শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অনুচররা চিরদিনের জন্য মঞ্চ থেকে অপসারিত হয়েছে। শয়তানি শক্তিকে চূর্ণবিচূর্ণ করার শক্তি যেন আমাদের অজেয় সশস্ত্র বাহিনীকে আল্লাহ দান করেন।’
আবুল কাশেম ফজলুল হকের ছেলে আবুল কালাম ফয়জুল হক ছিলেন ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামি লিগের বিজয়ী একশো সাতষট্টি সাংসদের একজন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের তিনি পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল তিনি বলেছিলেন— ‘আমি আমার পূর্ব পাকিস্তানি ভাইদের আমাদের এবং প্রশাসনযন্ত্রের ওপর আস্থা রাখার আবেদন জানাচ্ছি। যারা এখনও কোনো কারণবশত কিংবা কোনো মোহে পড়ে কাজে যোগদান করেননি, তাদের আমি শুধু বলব— সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে এবং আমরা যদি আমাদের নিজেদের সঠিক পথে ফিরে যাই, তা হলে প্রত্যেকটি মিনিটের নিজস্ব একটি মূল্য রয়েছে। ঐক্যবদ্ধভাবে একই মানুষ হিশেবে ছ’বছর আগে আমরা যেমন ভারতের নগ্ন আক্রমণকে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম, এখনও তেমনিভাবে তাদের নগ্ন আক্রমণের জন্য আমাদেরকে প্রস্তুত থাকতে হবে। আমরা আমাদের স্বার্থ ও আদর্শের জন্য সংগ্রাম করছি। ইনশাআল্লাহ, জয় আমাদের সুনিশ্চিত।’ আখতার সোলায়মান, রইসি বেগম ও ফয়জুল হকের ব্যাপারে অদ্যাবধি যা-কিছু লিখলাম, সবকিছুর উৎস হলো ‘মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র’ কর্তৃক প্রকাশিত বই ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’। যা হোক, ফয়জুল হক দালাল আইনে গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করেন এবং ১৯৭৯ সালে বিএনপিতে যোগ দিয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন।
চাঞ্চল্যকর ব্যাপার হলো— ফয়জুল হক পরবর্তীকালে আবারও আওয়ামি লিগে যোগ দেন এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামি লিগের টিকেটে সাংসদ হন, আওয়ামি লিগ তাকে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রী বানায়। জামালপুরের নুরুল ইসলামের স্বাধীনতাবিরোধিতা প্রমাণিত না হলেও বরিশালের ফয়জুল হকের স্বাধীনতাবিরোধিতা প্রমাণিত ও মীমাংসিত। ইতিহাস থেকে আওয়ামি লিগ মুছে দিতে পারবে না— দালাল আইনে জেল খাটা স্বাধীনতাবিরোধী ফয়জুল হককে আওয়ামি লিগ ১৯৯৬ সালে প্রতিমন্ত্রী বানিয়েছিল, স্বাধীনতাবিরোধী গাড়িতে জাতীয় পতাকা ওড়ার ব্যবস্থা করেছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া অন্য সব শাসকের মন্ত্রিসভায়ই স্বাধীনতাবিরোধী ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে আওয়ামি লিগের জেলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটিগুলায় অনেক স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন; জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও আওয়ামি অনেক স্বাধীনতাবিরোধীকে মনোনয়ন দিয়েছে, এখন দিচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধীদের সন্তানদেরকে। বিভিন্ন সময়েই শোনা যায়— কোনো বড় নেতার হাতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে জামায়াতে ইসলামির এক ঝাঁক নেতাকর্মী আওয়ামি লিগে যোগ দিয়েছেন। এ নিয়ে আওয়ামি লিগে প্রকাশ্য সমালোচনা হয় না বললেই চলে, উলটো শোনা যায়— এদেরকে সংশোধনের সুযোগ না দিলে এরা উগ্রবাদী কাজকর্ম করবে, বিএনপিতে যোগ দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে আরো শক্তিশালী করবে, মেধার অপচয় হবে। অর্থাৎ তখন আওয়ামি লিগ পরিণত হয় মাদকাসক্ত পুনর্বাসনকেন্দ্রে। আওয়ামি লিগে যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত জামায়াত-নেতারা রেজাকার থাকলেও আওয়ামি লিগে যোগ দেওয়ার পরক্ষণেই তারা হয়ে যান নও-মুক্তিযোদ্ধা। এমনকি, আজন্ম আওয়ামি লিগ করে আসা পুরোনো নেতাকর্মীদেরকে উপেক্ষা করে এই নও-মুক্তিযোদ্ধাদেরকেই আওয়ামি লিগে দেওয়া হয় অধিকতর লোভনীয় পদ-পদবি। স্বাধীনতাবিরোধীদের বংশধরদের সাথে আওয়ামি লিগের কেন্দ্রীয় নেতাদের আত্মীয়তার সম্পর্কও কিংবদন্তিতুল্য, এর তালিকা তৈরি করতে গেলে তা রীতিমতো একটা ওয়েবসাইটে পরিণত হবে। আওয়ামি লিগের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতাদের বেয়াইয়ের বাবারা কিংবা বেয়াইরা চিহ্নিত রেজাকার। সেসবের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে উত্তর আসে— ‘আমার বেয়াই ইচ্ছে করে রেজাকার হননি, তাকে জোরপূর্বক রেজাকার বানানো হয়েছিল’ অথবা ‘একাত্তরে তিনি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সহযোগিতা করেছিলেন, হিন্দুদেরকে আশ্রয় দিয়েছিলেন’ অথবা ‘রেজাকার মানেই যুদ্ধাপরাধী না, যুদ্ধাপরাধী মানেই রেজাকার না।’ অর্থাৎ আওয়ামি লিগের রেজাকাররাও রেজাকার না, অন্যান্য দলের মুক্তিযোদ্ধারাও রেজাকার।
২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে ভাষাসৈনিক আবদুল গাফফার চৌধুরী বলেছিলেন— ‘আওয়ামি লিগের ভেতরে জামায়াতের লোকও আছে। আওয়ামি লিগে কত রেজাকার আছে! বিপদের সময়ে এরা ভয়ানকভাবে আসে। রেজাকারদের লিস্ট করার আগে এই রেজাকারদের তালিকা প্রকাশ করা উচিত। রেজাকারদের তালিকা করলে দেখা যাবে, রেজাকাররাই সেই তালিকা তৈরি করছে। ওই তালিকায় মুক্তিযোদ্ধারা রেজাকার, রেজাকাররা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যাবে। অনেক রেজাকার আছে। এখনও আছে। এমনকি আমাদের জননেত্রী শেখ হাসিনার আশপাশেও আছে। তাদের নাম বললে আমার আর ঢাকায় আসা হবে না। তাই আমি নাম বলতে চাই না। এই হচ্ছে অবস্থা।’
‘আজকের কাগজ’ পত্রিকায় ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাসে আহমদ ছফা লিখেছিলেন— ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি, আওয়ামি লিগের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছি। শুধু তার দুর্নীতি এবং অহংপুষ্ট মনোভাবের সমালোচনা করেছি বলে আওয়ামি লিগের লোকেরা আমাদের প্রাপ্য সম্মান, অধিকার এবং মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করেছে। আজকে আওয়ামি লিগকে জামায়াতে ইসলামির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন করতে হচ্ছে। কোন জামায়াত- যারা একাত্তরে নরহত্যা করেছে বলে অভিযোগ করা যায়। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। আমি সবিনয়ে একটা প্রশ্ন করতে চাই— আমাদের অপরাধ ছিল কি? মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের থেকেও আমরা কি অধিকতর অপরাধী ছিলাম?’ একই কলামে তিনি আরো লিখেছেন— ‘আওয়ামি লিগ বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দল। তাদের নেতৃত্বে স্বাধীনতার সংগ্রামটি পরিচালিত হয়েছে বটে। এই সংগ্রামের একটি জাতীয় চরিত্র ছিল। জাতীয় সংগ্রামকে দলীয় সংগ্রামে পরিণত করতে যেয়ে আওয়ালি লিগকে শুরু থেকে পর্যায়ক্রমে একই অপরাধ করে যেতে হচ্ছে, সেই একই ধরনের অপরাধের মধ্যে যেটি সবচেয়ে কলঙ্কময়, সেটি হলো জামায়াতের সঙ্গে ঐক্যে আবদ্ধ হওয়া। আওয়ামি লিগ স্বাধীনতার পক্ষে সমস্ত শক্তিকে অস্বীকার করে দলীয়ভাবে যখন স্বাধীনতার ধারক-বাহকের ভূমিকা গ্রহণ করতে চায়, তার দুর্বল মেরুদণ্ডের জন্যে স্বাধীনতাকে সে ধারণ করতে পারে না। জাতীয় আকাঙ্ক্ষার বদলে দলীয় অহমিকা তার এতই প্রবল যে, সেটা টিকিয়ে রাখার জন্যে জাতীয় শত্রুদের সঙ্গে হাত মেলাতেও তার বাধে না। আমি একটি দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম— আওয়ামি লিগ যখন জেতে, শেখ হাসিনা ও তার অনুগ্রহভাজন ব্যক্তিরা জেতে। কিন্তু আওয়ামি লিগ যখন হারে, গোটা বাঙালি জাতি পরাজিত হয়— এই সত্যটি আওয়ামি লিগ অনুধাবন করবে কি?’
কয়েকজন স্বাধীনতাবিরোধীর পরিবারকে শেখ মুজিবুর রহমান উদারতা দেখিয়ে প্রতীকী খোরপোশ দিয়েছিলেন। এই বাবদ তাকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সুযোগ কম। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক হিশাবনিকাশ মোটেই সরলরৈখিক বা সহজ-সরল ছিল না। তৎকালীন বিশ্বরাজনীতির মারপ্যাঁচে শেখ মুজিবুর রহমানকে এমন অনেক কিছুই করতে হয়েছে, যা তার নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালের মন্ত্রিসভায় দুজন স্বাধীনতাবিরোধীকে ঠাঁই দেওয়ার পক্ষে কোনো অজুহাত দাঁড় করানোর সুযোগ আওয়ামি লিগের নেই। ১৯৯১-এর রাষ্ট্রপতি-নির্বাচনে জামায়াতের সহযোগিতা চাওয়াকেও আওয়ামি লিগ এখন অস্বীকার করতে চাইবে, ইতিহাস থেকে মুছে দিতে চাইবে। ১৯৯১-এ সরকারগঠনের জন্য আওয়ামি লিগ জামায়াতের সহযোগিতা চেয়েছিল বা গোলাম আজমকে মন্ত্রিত্ব দিতে চেয়েছিল— আজমের এই দাবি সত্য হলে তা আওয়ামি লিগের এখনকার রাজনীতিকে শূন্য দিয়ে গুণ করে দেয়। যেকোনো সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে গুণ করলে ফলাফল শূন্যই হয়। ফয়জুল হককে আওয়ামি লিগ কেন মন্ত্রিত্ব দিয়েছিল, গোলাম আজমকে আওয়ামি লিগ মন্ত্রিত্ব সেধেছিল কি না, সাধলে কেন সেধেছিল, আওয়ামি লিগের প্রার্থী বদরুল হায়দার চৌধুরী কেন রাষ্ট্রপতি-নির্বাচনের প্রাক্কালে গোলাম আজমের সাথে দেখা করেছিলেন, সাংবাদিকসম্মেলনে শেখ হাসিনার পাশে নিজামী কেন, একানব্বইয়ে রাষ্ট্রপতি-নির্বাচনে জামায়াত বদরুল হায়দারকে সমর্থন দিলে বা গোলাম আজম আওয়ামি লিগের মন্ত্রিত্ব নিলে এর বিশ বছর পর যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াত-নেতাদের বিচার হতো কি না— ইতিহাস আওয়ামি লিগকে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি করবেই। এসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আওয়ামি লিগ ইতিহাসের পুলসিরাত পেরোতে পারবে না।
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২3