বিএনপি কি স্বাধীনতার পক্ষের দল? আখতারুজ্জামান আজাদ

বিএনপি কি স্বাধীনতার পক্ষের দল?
আখতারুজ্জামান আজাদ

শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী পুনরায় অন্ধকারের দিকে যাত্রা শুরু করে, দেশের শীর্ষপর্যায়ে পুনঃপ্রবর্তিত হতে থাকে পাকিস্তানি ভাবধারা, ফাঁকফোকরে লুকিয়ে থাকা স্বাধীনতাবিরোধীরা গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। শাসকরাও স্বাধীনতাবিরোধীদেরকে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করা শুরু করেন। সদ্যস্বাধীন দেশে একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারাই কোণঠাসা হয়ে পড়েন, বীরদর্পে দেশজুড়ে দবদবিয়ে হাঁটতে থাকে স্বাধীনতার সক্রিয়-সশস্ত্র বিরোধিতা করা দেশীয় দোসররা। এই পুনর্বাসনপ্রক্রিয়া শুরু করেন সাবেক আওয়ামি লিগ-নেতা ও শেখ মুজিব-মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ। মোশতাক ক্ষমতায় ছিলেন তিরাশি দিন। এই ক’দিনেই তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের মেরুদণ্ড ভেঙে দেন, বাংলাদেশকে সিকি-পাকিস্তান বানিয়ে ফেলেন। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান মুক্তিযুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণে মোশতাক ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’-এর আদলে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান নির্ধারণ করেন ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’, বাংলাদেশ বেতারের নাম বদলে ‘রেডিও পাকিস্তান’-এর আদলে নাম রাখেন ‘রেডিও বাংলাদেশ’, বাংলাদেশের জাতীয় পোশাক প্রবর্তন করেন পাকিস্তানি পোশাকের অনুকরণে। শেখ মুজিবুর রহমান যেহেতু স্বাধীন বাংলাদেশের মূর্ত প্রতীক ছিলেন, সেহেতু তাকে হত্যা করার পর পরবর্তী শাসকরা বাংলাদেশকে একাত্তরপূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল মোশতাকের হাত ধরে।

বারো সপ্তাহ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার পর খন্দকার মোশতাক সামরিক অভ্যুত্থানে গদিচ্যুত হন। ব্যাপক রক্তক্ষয়ী চড়াই-উতরাইয়ের পর ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন, তাকে এই দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হয় ১৯৭৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। সায়েমের শাসনকালের পুরোটা সময়জুড়েই সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। তখন সায়েম ছিলেন নামমাত্র রাষ্ট্রপতি। সামরিক শাসন জারি থাকায় রাষ্ট্রক্ষমতা তখন মূলত জিয়ার হাতেই ছিল। জিয়া ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে সায়েমকে অকস্মাৎ ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেই রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন এবং ১৯৮১ সালের মে মাসে সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হন (জিয়া সায়েমকে কীভাবে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন, তা জানার জন্য সায়েমের আত্মজৈবনিক বই ‘বঙ্গভবনে শেষ দিনগুলি’ পড়া যেতে পারে)। পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ক্ষমতার সাড়ে পাঁচ বছরে জিয়া মোশতাকের অসমাপ্ত কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছিলেন। বাংলাদেশকে শতভাগ পাকিস্তানি ভাবধারায় পরিচালনার গুরুদায়িত্ব জিয়ার হাতেই সম্পন্ন হয় বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের যে ধারা মোশতাক শুরু করেছিলেন, জিয়া তা অব্যাহত রাখেন এবং সেই প্রক্রিয়া জারি রাখেন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়া।

১.
মুজিবহত্যার পর খন্দকার মোশতাক বিশ্ব-ইতিহাসে নজিরবিহীন এক কাজ করেন। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি কুখ্যাত ‘দায়মুক্তি অধ্যাদেশ’ জারি করেন। সেই অধ্যাদেশে লেখা ছিল— ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে সাধিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিবর্তনের এবং সামরিক আইন ঘোষণার জন্য কোনো পরিকল্পনা প্রস্তুত ও বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বা এরূপ পরিবর্তন বা ঘোষণার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিশেবে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক কোনো কাজকর্ম, বিষয় বা ঘটনার জন্য বা কারণে বা প্রসঙ্গে এরূপ ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট ও কোর্ট মার্শাল কোনো আদালতের বা কর্তৃপক্ষের সমীপে বা নিকটে বা দ্বারা কোনো মামলা, অভিশংসন বা অন্য আইনগত বা শৃঙ্খলামূলক কার্যধারা গ্রহণযোগ্য হবে না বা গৃহীত হবে না।’ অর্থাৎ পনেরোই আগস্ট ভোরে শেখ মুজিবুর রহমানকে যে হত্যা করা হয়েছে, এর কোনো বিচার-আচার করা যাবে না। ‘দায়মুক্তি অধ্যাদেশ’ জারি করে মোশতাক শেখ মুজিবের খুনিদেরকে দায়মুক্ত করে দিয়েছিলেন। দেশে যখন সংসদ থাকে না, রাষ্ট্রপতি তখন অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন; তবে, অধ্যাদেশ মানেই আইন না। পরবর্তী সংসদ অনুমোদন দিলে ঐ অধ্যাদেশ তবেই আইনে পরিণত হবে, অনুমোদন না দিলে অধ্যাদেশ বাতিল হয়ে যাবে। ১৯৭৯ সালের এপ্রিল মাসে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সংসদ সেই ‘দায়মুক্তি অধ্যাদেশ’কে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে আইনে পরিণত করে এবং মুজিবহত্যাকাণ্ডের বিচার চিরস্থায়ীভাবে রুদ্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচারবন্ধে প্রণীত অধ্যাদেশ জিয়াউর রহমান কর্তৃক আইনে রূপান্তরের এই ঘটনায়ই প্রতীয়মান হয়— ভাবাদর্শে জিয়া ছিলেন মোশতাকেরই উত্তরসূরি, ক্ষেত্রবিশেষে মোশতাকের চেয়েও কয়েক কাঠি বেশি সরেস। ‘দায়মুক্তি অধ্যাদেশ’ জারি মোশতাকের এবং তা অনুমোদন ছিল জিয়ার উল্লেখযোগ্য স্বাধীনতাবিরোধী কাজ।

২.
‘দায়মুক্তি অধ্যাদেশ’কে আইনে পরিণত করার জন্য সংসদে যিনি বিল উত্থাপন করেছিলেন, তার নাম শাহ্ আজিজুর রহমান। আজিজ মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে তিনি জাতিসংঘে পাকিস্তানের কূটনীতিক দলের নেতৃত্ব দেন, বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার কথা অস্বীকার করেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিশেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের আগে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে শেখ মুজিব যে দাবি তুলেছিলেন, আজিজ এরও বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ৪ মে আজিজ বিবৃতি দেন— ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রবল উৎকণ্ঠার সঙ্গে রাজনৈতিক দলসমূহকে অধিকতর স্বাধীনতা প্রদানপূর্বক দেশে পূর্ণ এবং বাধাহীনভাবে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল অধুনালুপ্ত আওয়ামি লিগ এই সুযোগের ভুল অর্থ করে বল প্রয়োগ আর শিরশ্ছেদের মাধ্যমে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিশাবে জয়লাভ করে অজেয়ভাবে নিজেদের খেয়ালখুশিতে দেশ শাসন করার দাবি করে এবং এভাবেই অহমিকা, অধৈর্য এবং ঔদ্ধত্যের ফলে নিজেদের ভাসিয়ে দেয়। সাম্রাজ্যবাদী ভারতের দুরভিসন্ধি নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য আমি জনগণের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি।’ (তথ্যসূত্র : একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়, পৃষ্ঠা ৯১)

১৯৭২ সালের দালাল আইনে আজিজ গ্রেপ্তার হন এবং শেখ মুজিব সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার পর ১৯৭৩ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পান। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকার জন্য আজিজকে জাতীয় সংসদ ভবনের ভেতরেই একাধিকবার শারীরিকভাবে নাজেহাল করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালের এপ্রিল মাসে এ রকম একজন চিহ্নিত দালাল ও ঘোরতর স্বাধীনতাবিরোধীকে প্রধানমন্ত্রী হিশেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। শাহ্ আজিজুর রহমানের আগে জিয়াউর রহমান আরেকজনকে প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদা দিয়ে ‘সিনিয়র মিনিস্টার’ বানিয়েছিলেন (১৯৭৮ সালের জুন থেকে ১৯৭৯ সালের মার্চ পর্যন্ত)। তার নাম মশিউর রহমান জাদু মিয়া। যথারীতি, জাদু মিয়াও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। এই অপরাধে শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে তিনি তিন বছর দুই মাস জেলও খেটেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার সাত-আট বছরের মাথায়ই জিয়াউর রহমানের কল্যাণে বাংলাদেশ দুই-দুইজন স্বাধীনতাবিরোধীকে প্রধানমন্ত্রী-পদে দেখতে পায়, যা তখনও ক্ষতস্থান না-শুকোনো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ছিল নিঃসন্দেহে নরকযন্ত্রণা। উল্লেখ্য, জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায়ও স্বাধীনতাবিরোধীদের জয়জয়কার ছিল।

(কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতা লিখেছিলেন ১৯৭৭ সালের ৩ ডিসেম্বর, একুশ বছর বয়সে। কবিতাটার একটা বাক্য— ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন।’ রুদ্র বেঁচে থাকলে জিজ্ঞেস করা যেত ‘পুরোনো শকুন’ কে বা কারা এবং কোনো যুদ্ধাপরাধী মন্ত্রীর গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়তে দেখে তিনি এই কবিতাটা লিখেছিলেন কি না। ১৯৯১ সালে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে রুদ্র সকল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে চলে যান।)

৩.
১৯৭২ সালের দালাল আদেশে দণ্ডিত কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের ভোটার হতে পারবেন না (অর্থাৎ নির্বাচনেও প্রার্থী হতে পারবেন না)— এ রকম বিধানসংবলিত একটা অনুচ্ছেদ (১২২-এর ঙ) বাহাত্তরের সংবিধানে সংযুক্ত ছিল। এর মানে হলো— মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দালালি করে হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগে অংশগ্রহণকারী কোনো ব্যক্তি আদালত কর্তৃক দোষী প্রমাণিত হলে তিনি বাংলাদেশের ভোটারও হতে পারবেন না; নির্বাচনও করতে পারবেন না। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো— জিয়াউর রহমান সংবিধান থেকে এই অনুচ্ছেদটাও তুলে নিয়েছিলেন। এর ফলে, দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীরা পুনরায় ভোটার হওয়ার এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পান। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধীদেরকে ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার এবং তাদেরকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করে দিয়েছেন জিয়া। ‘দালাল আদেশ’ বা ‘কলাবরেটর্স অর্ডার’ পাশ করেছিলেন শেখ মুজিব। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালে তিনি এই আইন পাশ করেন। এই আইনে সাঁইত্রিশ হাজারের বেশি অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী কারাগারে ছিলেন। হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ— সুনির্দিষ্টভাবে এই চার অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত না থাকা আসামিদের জন্য শেখ মুজিব সাধারণ ক্ষমাও ঘোষণা করেন। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও এগারো হাজারের বেশি অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী কারাগারে ছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর সামরিক আদেশ-বলে জিয়াউর রহমান ‘দালাল আদেশ’ বাতিল করে দেন, এই আইনের অধীন বন্দিদেরকে কারামুক্ত করে দেন, এমনকি এই আইনে দণ্ডিতদেরকেও (৭৫২ জন) তিনি মুক্ত করে দেন। বাহাত্তরের সংবিধানের প্রথম তফসিলে বর্ণিত ছিল— অন্যান্য বিধান সত্ত্বেও, অন্য কোনো আইনের সাথে যদি কোনোভাবে সাংঘর্ষিকও হয়, তা হলেও ১৯৭২ সালের ‘দালাল আদেশ’ কার্যকর থাকবে। জিয়া সংবিধানের প্রথম তফসিল থেকে এই বিধানও তুলে নেন।

৪.
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যেসব রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের জন্মের সক্রিয় ও সশস্ত্র বিরোধিতা করেছিল; মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে খুব স্বাভাবিকভাবেই সেসব দল রাজনীতিতে ফিরে আসার দুঃসাহস দেখায়নি, দলগুলোর সাধারণ নেতাকর্মীরা দেশেই গা-ঢাকা দিয়ে ছিলেন, শীর্ষ নেতারা পাকিস্তান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা না-চাওয়া বিভিন্ন দেশে পালিয়ে ছিলেন। ফলে, ঐ দলগুলোকে সদ্য স্বাধীন দেশে আলাদাভাবে নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন পড়েনি। শেখ মুজিবুর রহমান, তবুও, বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন। বাহাত্তরের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৮-এ উল্লিখিত ছিল— ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী কোনো সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোনো সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোনো প্রকারে তাহার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করিবার অধিকার কোনো ব্যক্তির থাকিবে না।’ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দলগুলোর অধিকাংশই যেহেতু ধর্মভিত্তিক ছিল এবং যেহেতু পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর তাদের এ দেশীয় দোসররা ধর্মের দোহাই দিয়েই গণহত্যা চালিয়েছিল, সেহেতু মুজিব ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। ধর্মভিত্তিক একটি সংগঠনও মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করেনি। মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতাকারী শীর্ষ সংগঠন ছিল জামায়াতে ইসলামি; এই তালিকায় এ ছাড়া ছিল নেজামে ইসলাম, ওলামায়ে ইসলাম, কৃষক-শ্রমিক পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি, মুসলিম লিগও। মুসলিম লিগের ছিল তিন গ্রুপ। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর যে প্রয়োজনীয় নিষেধাজ্ঞা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ছিল, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তাও প্রত্যাহার করে নেন। ফলে, স্বাধীন দেশে জামায়াতে ইসলামি-সহ স্বাধীনতাবিরোধী অন্যান্য দলের রাজনীতিতে আর কোনো বাধা রইল না। জিয়াউর রহমান শুধু দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের ভোটাধিকারই ফিরিয়ে দেননি, তাদেরকে রাজনীতি করার এবং নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সমস্ত সুযোগও তৈরি করে দিয়েছিলেন।

৫.
‘দালাল আদেশ’ পাশ হয়েছিল ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি। ১৯৭২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যেসব আসামি ট্রাইবুনালে উপস্থিত হতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, ১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিল তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে বাংলাদেশ সরকার। তখন ঊনচল্লিশজনের নাগরিকত্ব বাতিল হয়েছিল, এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন একাত্তরের গণহত্যার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড জামায়াত-নেতা গোলাম আজম। আজম ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে পাকিস্তানের নাগরিক হিশেবে তিনি বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন, বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালিয়েছেন (যাতে কোনো দেশ বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিশেবে স্বীকৃতি না দেয়) এবং পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের কনফেডারেশন তৈরির চেষ্টা করেছেন। মুজিব জীবিত থাকাকালে আজম, খুব স্বাভাবিকভাবেই, বাংলাদেশে ফিরে আসার বা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার কথা কল্পনাও করেননি। যারা নাগরিকত্ব চায়, ১৯৭৬ সালের ২০ মে জিয়াউর রহমান তাদের জন্য একটা প্রেস নোট জারি করেন এবং সেই সুযোগ নিয়ে আজম বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য একাধিকবার প্রচেষ্টা চালান। মায়ের মৃত্যুকে পুঁজি করে আজম ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। সে বছর জিয়াউর রহমান তাকে দুইবার ভিসা নবায়ন করার সুযোগ দেন। ঐ বছরেরই নভেম্বর মাসে আজম বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাকিস্তানি পাসপোর্ট জমা দিয়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু বিভিন্ন আইনি জটিলতার কারণে জিয়ার জীবদ্দশায় আজম নাগরিকত্ব পাননি। কিন্তু ইতিহাসে লেখা থাকবে— যুদ্ধাপরাধের দায়ে পরবর্তীকালে নব্বই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধী গোলাম আজম জিয়াউর রহমানের আমলেই দেশে ফেরার সুযোগ পেয়েছিলেন, জিয়ার অবশিষ্ট জীবনকালের পুরোটাজুড়েই আজম অবৈধভাবে বাংলাদেশে ছিলেন।

৬.
বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের অত্যন্ত শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল দ্বাদশ অনুচ্ছেদ। তাতে লেখা ছিল— ‘ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ব্যবহার, কোনো বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।’ মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সরকার, পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা গণহত্যার অজুহাত হিশেবে ধর্মকে ব্যাপকভাবে ব্যবহারের কারণে নবগঠিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা অনিবার্য ছিল। পাকিস্তান নামক ধর্মরাষ্ট্রের পিঞ্জর ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা একটা রাষ্ট্রও কোনোক্রমেই আরেকটা ধর্মরাষ্ট্র হতে পারে না, সেই রাষ্ট্রে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থাকতে পারে না, সেই রাষ্ট্রের কোনো রাষ্ট্রধর্মও থাকতে পারে না। ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নির্বাসনে পাঠান (এবং এরই সূত্র ধরে আরেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৮ সালে অষ্টম সংশোধনী এনে সংবিধানে অতর্কিতে রাষ্ট্রধর্ম সংযুক্ত করেন)। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা উঠিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পুনরায় চালু করার জন্য। পূর্ব পাকিস্তানের সবগুলো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলই মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় বিরোধিতা করেছিল। ফলে, স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করে দেওয়ার অর্থই হলো কিছু স্বাধীনতাবিরোধী দলকে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করা। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা উঠিয়ে নিয়ে জিয়াউর রহমান মূলত স্বাধীনতাবিরোধী চক্রকেই রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।

৭.
শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সাথে জিয়াউর রহমান প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত কি না, তা স্পষ্টভাবে জানা যায় না। তবে, ‘দায়মুক্তি অধ্যাদেশ’ অনুমোদনের পাশাপাশি মুজিবের স্বঘোষিত খুনিদেরকে জিয়া বিভিন্নভাবে পুরস্কৃতও করেছিলেন। শেখ মুজিবকে সপরিবারে যারা হত্যা করেছিলেন, সেই খুনিদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করেছিলেন জিয়াউর রহমান। যেহেতু মোশতাক, সায়েম ও জিয়ার সরকার ছিল সরাসরি মুজিবহত্যার ফসল; সেহেতু এই তিন সরকারে মুজিবের খুনিরা, খুব স্বাভাবিকভাবেই, নিজেদের প্রভাব ও প্রভুত্ব বিস্তার করতে চেয়েছিলেন। মোশতাক ও সায়েম সেই প্রভাব-প্রভুত্ব হজম করলেও জিয়া হজম করেননি। বরং বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে শান্ত রেখেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের মধ্যে শরিফুল হক ডালিমকে চীন দূতাবাসের প্রথম সচিব, আজিজ পাশাকে আর্জেন্টিনার প্রথম সচিব, একেএম মহিউদ্দিন আহমেদকে আলজেরিয়ার প্রথম সচিব, বজলুল হুদাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় সচিব, শাহরিয়ার রশিদকে ইন্দোনেশিয়ার দ্বিতীয় সচিব, রাশেদ চৌধুরীকে সৌদি আরবের দ্বিতীয় সচিব, নূর চৌধুরীকে ইরানের দ্বিতীয় সচিব, শরিফুল হোসেনকে কুয়েত দূতাবাসে দ্বিতীয় সচিব হিসেবে চাকরি দেওয়া হয় জিয়াউর রহমানের আমলে। স্বাধীনতার স্থপতির খুনিদের বিচারের ব্যবস্থা না করে উলটো পুরস্কারস্বরূপ চাকরি দিয়ে বিদেশে আয়েশী জীবন যাপনের সুযোগ করে দেওয়া নিশ্চয়ই স্বাধীনতার স্বপক্ষের কারো কাজ হতে পারে না।

৮.
অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো— ১৯৮০ সাল পর্যন্ত টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে সার্বক্ষণিক কড়া পাহারা বসানো থাকত, যাতে কেউ ঐ সমাধিতে ঘেঁষতে না পারে। কেউ সমাধির কাছাকাছি গেলে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হতো। মুজিবের কবর জিয়ারত করার অপরাধে হাজি গোলাম মোরশেদ নামক একজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের বাড়িটাও তালাবদ্ধ করে রাখা হতো। এই তথ্য পাওয়া যায় অধ্যাপক আবু সাইয়িদের ‘মুক্তিযুদ্ধের দলিল লণ্ডভণ্ড এবং অতঃপর’ বইয়ের ৮০ পৃষ্ঠায়। জিয়াউর রহমানের জীবদ্দশায় বেতারে-টেলিভিশনে শেখ মুজিব অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধই ছিলেন। তখন সরকারি গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ততটুকু ইতিহাসই প্রচার করা হতো, যতটুকুর সাথে জিয়াউর রহমানকে সংশ্লিষ্ট করা যায়।

৯.
এ কথা সর্বজনবিদিত— রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা-আন্দোলনের পরোক্ষ দিকনির্দেশনাসংবলিত ভাষণ দেওয়ায় ৭ মার্চ তারিখটা গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে। জিয়া ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ, সেই রেসকোর্স ময়দানে বিমানবাহিনীপ্রধান গোলাম তাওয়াবকে দিয়ে ‘সিরাত মাহফিল’ আয়োজন করান। তাতে বক্তব্য রাখেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা, যাদের অধিকাংশই বাহাত্তরের দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত। বক্তব্য রাখেন তরুণ মওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীও। যে রেসকোর্স ময়দানে যে তারিখে স্বাধীনতার স্থপতি স্বাধীনতা-আন্দোলনের রূপরেখা ঘোষণা করেছেন, স্বাধীনতাবিরোধীরা মুক্তিযুদ্ধের মাত্রই সোয়া চার বছরের মাথায় সেই রেসকোর্স ময়দানে ঠিক সেই তারিখেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক মাহফিল আয়োজন করেছে— এই দৃশ্য দেখার পর শহিদপরিবারগুলোর অনুভূতি কী হয়েছিল, তা সহজেই অনুমেয়। স্বাধীনতাবিরোধীদেরকে একযোগে মাঠে নামালে মুক্তিযোদ্ধারা কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখান, তা পরখ করে দেখাই ছিল ঐ মাহফিল আয়োজনের উদ্দেশ্য। আলোচ্য মাহফিল থেকে দাবি ওঠে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের, এমনকি বাংলাদেশকে ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণারও। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র জিয়াউর রহমানের আমলেই এত দুঃসাহস পেয়েছিল। অর্থাৎ জিয়ার আমল ছিল যুদ্ধাপরাধীদের জন্য সবচেয়ে নিশ্চিত সময় তথা মধুচন্দ্রিমা-কাল।

১০.
ঢাকার শাহবাগে যে শিশুপার্কটি আছে; সেটি প্রতিষ্ঠা করেন জিয়াউর রহমান, ১৯৭৯ সালে। সেই সুবাদে পার্কটি বিএনপির আমলগুলোয় ‘শহিদ জিয়া শিশুপার্ক’ নামেও পরিচিত ছিল। কিন্তু এই পার্ক অরাজনৈতিক না। এই পার্কের পেছনেও সুগভীর রাজনীতি আছে। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ যে জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই জায়গা যাতে ভবিষ্যতে কখনও চিহ্নিত করা না যায় এবং ‘রেসকোর্স ময়দান’ বা ‘সোহরাওয়ার্দি উদ্যান’ নামোচ্চারণের সাথে-সাথে মানসপটে ৭ মার্চের ভাষণ ভেসে না উঠে অন্যকিছু ভাসে; সেজন্য জিয়াউর রহমান ঠিক ঐ জায়গায় বা এর কাছাকাছি স্থানে শিশুপার্ক নির্মাণ করেন। ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ এই উদ্যানেই ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন শেখ মুজিব এবং স্থাপন করেছিলেন ‘ইন্দিরা মঞ্চ’। শিশুপার্ক নির্মাণের আড়ালে সেই ‘ইন্দিরা মঞ্চ’ও নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দৈনিক যুগান্তরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুল মান্নানের লেখা একটা কলাম থেকে জানা যায়— ‘প্রয়াত সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী, যিনি বিএনপিঘেঁষা একজন সাংবাদিক ছিলেন, তিনি প্রেস ক্লাবের এক সেমিনারে বলেছিলেন— জিয়া চাননি কোনো মুসলমান জেনারেল অমুসলমানের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, এর কোনো স্মারক বাংলাদেশে থাকুক।’ শাহবাগে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শিশুপার্ক-নির্মাণের মাধ্যমে, বাংলাদেশের মুক্তি-আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ একটা স্থান জিয়া ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন; রেসকোর্স ময়দানকে তিনি পাদপ্রদীপের বাইরে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। জিয়ার কর্মকাণ্ড সাক্ষ্য দেয়— মুজিব-সংক্রান্ত যেকোনো কিছুতে তার আকণ্ঠ আক্রোশ ছিল, তার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা ছিল মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত বিভিন্ন স্মারকও নিশ্চিহ্ন করার।

নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা— এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতার কিছু পঙক্তি এ রকম— ‘এই শিশুপার্ক সেদিন ছিল না, এই বৃক্ষে-ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না, এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না। তা হলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি? তা হলে কেমন ছিল শিশুপার্কে বেঞ্চে-বৃক্ষে ফুলের বাগানে ঢেকে দেওয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি? জানি, সেদিনের সব স্মৃতি মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত কালো হাত। তাই দেখি— কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ কবির বিরুদ্ধে কবি, মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ, বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল, উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান, মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ’ (রচনাকাল ১৯৮০)। ৭ মার্চের সব স্মৃতি মুছে দিতে কালো হাত উদ্যত হয়েছিল বলে গুণ এখানে যে অভিযোগ করেছেন, সেই কালো হাত কার; তা নিশ্চয়ই বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এই নিবন্ধ লেখার মাঝপথে কবি নির্মলেন্দু গুণের সাথে কথা বলে জেনেছি— ‘উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান’ বলতে তিনি সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের (রেসকোর্স ময়দান) বিরুদ্ধে দাঁড় করানো শিশুপার্ককে বুঝিয়েছেন। শেখ মুজিবের জীবদ্দশায় রাজনৈতিক সমাবেশগুলো রেসকোর্স ময়দানেই হতো। তার মৃত্যুর পর ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’ চালু হলেও সামরিক শাসন জারি থাকার কারণে রাজনৈতিক সমাবেশের অনুমতি ছিল না। পরবর্তীকালে জিয়া ‘ঘরোয়া রাজনীতি’র অনুমতি দেন এবং গুলিস্তানে জিপিওর পার্শ্ববর্তী খালি জায়গায় (মুক্তাঙ্গন) ক্ষুদ্র পরিসরে সভা করার সুযোগ দেন। এই প্রক্রিয়াকেই গুণ ‘মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ’ বলেছেন। পনেরোই আগস্টের পর শাসকগোষ্ঠীকে তোয়াজ করার জন্য অখ্যাত অনেক কবি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কবিতা লিখেছিলেন এবং প্রগতিশীল কিছু কবি নিপীড়িত হওয়ার ভয়ে পনেরোই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নেননি। ‘কবির বিরুদ্ধে কবি’— এখানে প্রথমোক্ত ‘কবি’ স্বয়ং মুজিব (৭ মার্চের ভাষণ কবিতার মতো ছিল বিধায়) আর দ্বিতীয়োক্ত ‘কবি’ হলেন ঐ দুই শ্রেণির কবিসম্প্রদায়। আর ‘মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ’ বলতে গুণ শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণের বিপরীতে স্বাধীনতাবিরোধীদের ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চের সভা আর সামরিক শাসকদের মার্চপাস্টকে (কুচকাওয়াজ) বুঝিয়েছেন।

১১.
একটা ব্যাপার লক্ষণীয়— একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে আলোচনা উঠলে বিএনপি ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী’র নাম উচ্চারণ করে না। গণহত্যাকারী সংগঠনের নাম বলা অনিবার্য হয়ে উঠলে বিএনপি একটা শব্দ ব্যবহার করে— ‘হানাদারবাহিনী’। কোন দেশের কোন বাহিনী— বিএনপি পারতপক্ষে তা মুখে আনে না; ব্যাপারটা তারা ‘হানাদারবাহিনী’ দিয়েই চালিয়ে দেয়। একই উদ্দেশ্যে এই একই শব্দ জাতীয় পার্টিও ব্যবহার করে থাকে, ব্যবহার করে জামায়াতে ইসলামিও। ২০১৫ সালে শহিদ বুদ্ধিজীবীদিবস উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে বিএনপির খালেদা জিয়া এবং জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদ দুজনই বলেছেন ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা হানাদারবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন আর জামায়াতে ইসলামি বাণী দিয়েছে আরো ভাববাচ্যে— ১৪ ডিসেম্বর শাহাদাতবরণকারী বুদ্ধিজীবীদেরকে জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছে। বুদ্ধিজীবীরা কাদের দ্বারা শহিদ হয়েছেন, এর কোনো হদিস জামায়াতের বাণীতে ছিল না। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীনিধনে নেতৃত্ব দিয়েছিল জামায়াতেরই তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ছাত্রসংঘের কিলিং স্কয়াড আল-বদর। যা হোক, এই ‘হানাদারবাহিনী’ শব্দের আবিষ্কারক ও প্রবক্তা জিয়াউর রহমান। জিয়ার আমলে কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান, সংবাদপত্র ও পাঠ্যপুস্তকে ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী’, ‘রেজাকার’, ‘আল-বদর’ বা ‘আল-শামস’ শব্দগুলো ব্যবহৃত হতো না; ব্যবহৃত হতো ‘হানাদারবাহিনী’ (তথ্যসূত্র— ‘এক্সপ্লেইন হোয়াট ইজ হানাদারবাহিনী’, শাহরিয়ার খান, ডেইলি স্টার অনলাইন, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫)। জিয়ার আমলের পাঠ্যপুস্তক পড়ে শিক্ষার্থীরা জানতে পারত না এ দেশে গণহত্যা কারা চালিয়েছিল, কারা তাদের দালালি করেছিল। ‘হানাদারবাহিনী’ শব্দটা এখন এতটাই অবলীলায় ব্যবহৃত হয় যে, ব্যবহারকারীরা জানেনই না এই শব্দের আড়ালে কী গভীর রাজনীতি লুকিয়ে আছে। জিয়া এমন একটা প্রজন্ম গড়ে তোলার প্রয়াস নিয়েছিলেন— একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে যারা কিছুই জানবে না, জানবে না পাকিস্তানের এ দেশীয় দোসরদের সাংগঠনিক ও ব্যক্তিগত পরিচয়। পাকিস্তান কোনোভাবে বিরক্ত হয় বা বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীরা কোনোক্রমে বিব্রত হয়— ক্ষমতায় থাকাকালে এমন কোনো কাজ জিয়াউর রহমান করেননি।

১২.
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার সবুজ রঙ দেশের সবুজ প্রকৃতির প্রতীক। আর লাল বৃত্ত নির্দেশ করে স্বাধীনতার লাল সূর্য, তথা মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের রক্ত। অত্যন্ত অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো— ১৯৭৮ সালের বিজয়দিবসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নির্দেশ দেন ঢাকার কিছু সরকারি ভবনে সবুজের মাঝে লাল বৃত্তের পরিবর্তে কমলা বৃত্তের পতাকা ওড়ানোর জন্য। সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদের ‘জেনারেল জিয়ার রাজত্ব’ বইয়ে এই তথ্য পাওয়া যায়। পতাকার রঙে সামান্য পরিবর্তন এনে জিয়া পরীক্ষা করার চেষ্টা করছিলেন পতাকা পুরোপুরি পালটে ফেললে জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে। কিন্তু জাতীয় পতাকার এমন অবমাননার ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ হওয়ায় জিয়া এই দুরভিসন্ধিমূলক উদ্যোগ থেকে সরে গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের রক্তের লাল প্রতীককে জাতীয় পতাকা থেকে সরিয়ে দিতেও জিয়া দ্বিধাবোধ করেননি। উল্লেখ্য— এই ঘটনার চারদিন আগে, ১৯৭৮ সালের ১২ ডিসেম্বর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সিনেট অধিবেশনে কোরান তেলাওয়াতের আগে জাতীয় সংগীত গাওয়ায় জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রাম জেলা বিএনপির নেতা ডা. ইউসুফ বলেন— ‘স্যার, আমাদের পতাকায় ইসলামি রং নেই, এটা আমাদের ভালো লাগে না। এটা ইসলামি তাহজ্জিব ও তমুদ্দুনের সাথে মিলছে না।’ উত্তরে জিয়া বলেছিলেন— ‘হবে, হবে। সবকিছুই হবে। আগে হিন্দুর লেখা জাতীয় সংগীত বদলানো হোক। তারপর জাতীয় পতাকার কথা ভাবব।’ সাংবাদিক আবেদ খানের ‘ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি’ বইয়ে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

১৩.
জিয়াউর রহমান জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের উদ্যোগ নেন এর পরের বছর। ১৯৭৯ সালের ৩০ এপ্রিল জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রস্তাব আসে। ঐ সময়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান এক গোপন চিঠিতে মন্ত্রিপরিষদকে লেখেন— ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি গান ভারতীয় জাতীয় সংগীত। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক নন। আমার সোনার বাংলা গানটি আমাদের সংস্কৃতির চেতনার পরিপন্থি বিধায় জাতীয় সংগীত পরিবর্তন আবশ্যক।’ ঐ চিঠিতে ‘আমার সোনার বাংলা’র পরিবর্তে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’কে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করেন আজিজ (গীতিকার মনিরুজ্জামান মনির, সুরকার আলাউদ্দিন আলী)। প্রধানমন্ত্রীর ঐ চিঠি পেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রেডিও, টেলিভিশন এবং সব সরকারি অনুষ্ঠানে প্রথম বাংলাদেশ গানটি প্রচারের নির্দেশনাও জারি করে। এ সময়ে রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ গাওয়া শুরু হয়। কিন্তু জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের পরিকল্পনা ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর থেমে যায়। পাথরে চাপা পড়ে সেই নিদের্শনা।

জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের তোড়জোড় খালেদা জিয়ার আমলেও দেখা গিয়েছিল। ২০০২ সালের ১৯ মার্চ তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামির আমির মতিউর রহমান নিজামী এবং সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলি আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি যৌথ সুপারিশপত্র প্রধামন্ত্রীর কাছে জমা দেন। তাতে বলা হয়— সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের ইসলামি মূল্যবোধ ও চেতনার আলোকে জাতীয় সংগীত সংশোধিত হওয়া প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া চিঠিটা প্রত্যাখ্যান না করে সংস্কৃতিমন্ত্রণালয়ে পাঠান। সংস্কৃতিমন্ত্রী খুরশিদ জাহান হক (খালেদা জিয়ার আপন বড়বোন) বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে সচিবের কাছে প্রেরণ করেন। জাতীয় সংগীত পরিবর্তনকে সংস্কৃতিমন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারবহির্ভূত বিষয় অভিহিত করে সচিব তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠান। একই বছরের ১৯ আগস্ট প্রস্তাবটি সংস্কৃতিমন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু সেই সরকারের আমলে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়নি। এর পর এ সম্পর্কে আর কোনো তৎপরতা নথিতে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের অপচেষ্টা জিয়াউর রহমানের আমলেও হয়েছে, খালেদা জিয়ার আমলেও হয়েছে।

জিয়া দম্পতির বাইরে আরো একজন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বদলানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন— খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ১৯৭৫ সালের আগস্টে ক্ষমতায় বসেই মোশতাক জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী দীন মুহম্মদকে ঐ কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়। কমিটিকে বলা হয় এক মাসের মধ্যে নতুন কোনো গানকে ‘জাতীয় সংগীত’ হিশেবে প্রস্তাব করতে। সে কমিটি দুটো গানের একটিকে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করে প্রতিবেদন জমা দেয়— কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ এবং ফররুখ আহমদের ‘পাঞ্জেরী’ কবিতা। কিন্তু অভ্যুত্থান পালটা-অভ্যুত্থানে ঐ প্রস্তাব আর হালে পানি পায়নি। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধকালে কাজী দীন মুহম্মদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাকিস্তান-অনুগত দালাল শিক্ষকদের নেতা। দালাল শিক্ষকদের একটা দল নিয়ে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের সাথে দীন মুহম্মদ দেখাও করেছিলেন।

১৪.
বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ সংবিধান অনুমোদিত হয় প্রথম বিজয়দিবসে, ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সেই সংবিধানের শুরুতেই, অর্থাৎ প্রস্তাবনায়, বলা হয়— ‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।’ কিন্তু ১৯৭৯ সালে সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী আনেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান শব্দগত যে পরিবর্তনটি সংবিধানে এনেছিলেন, তা হলো— উল্লিখিত প্রস্তাবনায় তিনি ‘মুক্তি’র পরিবর্তে ‘স্বাধীনতা’ এবং ‘সংগ্রাম’-এর পরিবর্তে ‘যুদ্ধ’ শব্দটা প্রতিস্থাপন করেছেন। তাতে পুরো বাক্যটা দাঁড়িয়েছিল— ‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।’ জিয়াউর রহমানের পরিবর্তিত সংবিধান অনুযায়ী অর্থ দাঁড়ায়— একাত্তরের যুদ্ধ ছিল স্বাধীনতার জন্য, অথচ বাংলাদেশ (যুদ্ধের আগেই) ২৬ মার্চ থেকেই স্বাধীন। জিয়াউর রহমানের এই সংবিধান-মতে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ভূখণ্ড আসলে পূর্ব পাকিস্তানই ছিল, বাংলাদেশ ছিল না। এখানে শব্দের আরো দ্যোতনা ও যাতনা আছে। ‘ঐতিহাসিক যুদ্ধ’ বললে কেবল ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের সশস্ত্র যুদ্ধকে বোঝায়। কিন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামটা শুধু ঐ নয়মাসের সশস্ত্র সংগ্রাম ছিল না; তেইশ বছরের (১৯৪৭ থেকে ১৯৭১) অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামও ছিল। সংবিধানে ‘ঐতিহাসিক সংগ্রাম’ না বলে ‘ঐতিহাসিক যুদ্ধ’ বললে ঐ তেইশ বছরের সুদীর্ঘ সংগ্রামটাকে বেঘোরে অস্বীকার করা হয়। অস্বীকার করা হয় ১৯৫২-এর ভাষা-আন্দোলন, ১৯৫৪-এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, বাংলাকে ১৯৫৬-এর সংবিধানে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিশেবে অন্তর্ভুক্তকরণের আন্দোলন, ১৯৬২-এর শিক্ষা-আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ছয় দফা, ১৯৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্রমামলা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন কিংবা ১৯৭১-এর ৭ মার্চকে। সংবিধানে ‘ঐতিহাসিক যুদ্ধ’ কথাটা থাকার পরোক্ষ অর্থ দাঁড়ায়— নয়মাসের সামরিক যুদ্ধটা ভিনগ্রহ থেকে আচমকা আমদানি হয়েছে, এর আগের দুই যুগে আর কিছুই ঘটেনি, ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে ঘোষণার মাধ্যমে ‘ঐতিহাসিক যুদ্ধ’ শুরু হয়ে ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির সদলবল আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ‘ঐতিহাসিক যুদ্ধ’ শেষ হয়ে গেছে।

জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধ’-কে ‘স্বাধীনতাযুদ্ধ’ বানিয়েই ক্ষান্ত হননি। ১৯৮১ সালে তিনি অত্যন্ত অভাবনীয় একটা ঘোষণা দেন। তা হলো ২৬ মার্চ ‘স্বাধীনতাদিবস’ হিশেবে পালিত না হয়ে ‘জাতীয় দিবস’ নামে পালিত হবে এবং ১৬ ডিসেম্বর ‘বিজয়দিবস’ হিশেবে পালিত না হয়ে পালিত হবে ‘স্বাধীনতাদিবস’ হিশেবে। এর সুস্পষ্ট অর্থ হলো— এই ভূখণ্ডের লোকজন ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানের নাগরিক ছিল, ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই দেশ পাকিস্তানই ছিল। এর ফলে ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা, ১০ এপ্রিল অস্থায়ী সরকারগঠন (মুজিবনগর সরকার) ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (অস্থায়ী সংবিধান) প্রণয়ন, ১৭ এপ্রিল অস্থায়ী সরকারের শপথগ্রহণ অবৈধ হয়ে যায়; একাত্তরের যুদ্ধটা মুক্তিযুদ্ধ না হয়ে পরিণত হয়ে যায় বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধে। ১৯৭২ সালে যে ‘দালাল আদেশ’ পাশ করা হয়েছিল; সেই আইন অনুযায়ী বিচার করা সম্ভব ছিল শুধু দেশীয় দালালদের, পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের না। বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতাদিবস’ যদি ১৬ ডিসেম্বর হয়, তা হলে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ভূখণ্ডের সবাইকে পাকিস্তানের নাগরিক বলে গণ্য করতে হয়। সে হিশেবে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঐ দালালরাও ছিল পাকিস্তানের নাগরিক। এর মানে দাঁড়ায়— ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ভূখণ্ডে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচার করার জন্য বাংলাদেশ কোনো আইনই তৈরি করতে পারবে না (যেহেতু বাংলাদেশের আইন দিয়ে পাকিস্তানিদের বিচার করা যায় না)। ভবিষ্যতেও যেন কেউ এ দেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আইন তৈরি না পারে, জিয়াউর রহমান সেজন্য ‘স্বাধীনতাদিবস’ ২৬ মার্চের বদলে ‘১৬ ডিসেম্বর’ পালন করতে চেয়েছিলেন। ১৯৮১ সালের মে মাসেই নিহত হওয়ায় জিয়া ১৬ ডিসেম্বর একবারও স্বাধীনতাদিবস পালন করে যেতে পারেননি। ঐ বছরের ২৬ মার্চ ‘জাতীয় দিবস’ পালন করায় তিনি ব্যাপক প্রতিবাদের মুখোমুখি হন এবং ঘোষণা দেন— পরের বছর থেকে ২৬ মার্চ ‘জাতীয় দিবস’ হিশেবে পালিত না হয়ে ‘স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’ হিশেবে পালিত হবে। এসব তথ্য নিয়েছি অধ্যাপক আবু সাইয়িদের ‘জেনারেল জিয়ার রাজত্ব’ ও সাংবাদিক আবেদ খানের ‘ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি’ বই থেকে। মোদ্দা কথা— জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের বুক থেকে মুক্তিযুদ্ধ নামক অধ্যায়টাকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের নাম-নিশানা থাকুক— এর কোনো সুযোগই তিনি রাখতে চাননি। সংবিধান, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, রেসকোর্স ময়দান— ইত্যাকার এমন কিছু নেই, যা ধুয়েমুছে তিনি মুক্তিযুদ্ধের গন্ধ তাড়ানোর চেষ্টা করতে বাকি রেখেছেন।

১৫.
জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সশস্ত্রবাহিনীতে বেশ কয়েকবার অভ্যুত্থান ঘটেছিল। অভ্যুত্থানের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা পাওয়া যায় না; কেননা কোনটাকে অভ্যুত্থান বলে ধরা হবে, আর কোনটাকে অভ্যুত্থান ধরা হবে না— এর সর্বজনীন কোনো সংজ্ঞা নেই। কোথাও তথ্য পাওয়া যায় জিয়ার আমলে অভ্যুত্থান ঘটেছে উনিশবার, কোথাও তেইশবার, কোথাও সাতাশবার; গড়পড়তা ধরে নেওয়া যায় পঁচিশবার। জিয়ার বিরুদ্ধে সবচেয়ে তীব্র অভ্যুত্থান ঘটেছিল ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর, বিমানবাহিনীতে। প্রতিটা অভ্যুত্থানের পর জিয়াউর রহমান বিদ্রোহীদেরকে ফাঁসিতে ঝোলাতেন কিংবা ফায়ারিং স্কয়াডে পাঠাতেন। বলাই বাহুল্য যে, বিচারের স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক ন্যূনতম মানদণ্ডের ছিটেফোঁটাও জিয়া মেনে চলতেন না। মৃত্যুদণ্ডের আদেশে স্বাক্ষর করতে-করতে জিয়া ক্লান্ত হয়ে যেতেন। সেরেফ নাম মিলে যাওয়ার কারণে এক বন্দিকে ফাঁসি না দিয়ে আরেক বন্দিকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে— জিয়ার আমলে এমন ঘটনা সাধারণ ছিল। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার আগেই সৈন্যদের হাত-পায়ের রগ কেটে দেওয়া হতো, রক্তে ভেসে যেত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পার্শ্ববর্তী নর্দমা। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী লাশ সৎকারের সুযোগও দেওয়া হয়নি তখন। পরিবারগুলোও জানত না তাদের স্বজন বেঁচে আছেন, নাকি ফাঁসিতে ঝুলেছেন। অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত সন্দেহে জিয়াউর রহমানের হুকুমে সশস্ত্র বাহিনীর মোট কয়জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, এর সঠিক হিশাব এখন আর পাওয়া যায় না। অধিকাংশ নথি গায়েব করে ফেলা হয়েছে। তবে, এই সংখ্যাটা এক হাজার থেকে দুই হাজারের মাঝামাঝি (‘জিয়াউর রহমানের আমলে সেনাহত্যা’ লিখে গুগল করলেই এ সংক্রান্ত অসংখ্য লেখা পাওয়া যাবে)। জিয়ার আমলে নিখোঁজ হওয়া কিছু সেনাসদস্য এখনও নিখোঁজ। উল্লেখ্য জিয়াউর রহমানের হুকুমে ফাঁসিতে ঝোলানো বা ফায়ারিং স্কয়াডে পাঠানো সেনাসদস্যদের একটা বড় অংশই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।

১৬.
জিয়াউর রহমানের দুটো উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পদক্ষেপ ছিল ‘একুশে পদক’ ও ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রবর্তন। তিনি ১৯৭৬ সালে ‘একুশে পদক’ এবং ১৯৭৭ সালে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রবর্তন করেন। জিয়ার আমলে দেশের প্রথিতযশা ব্যক্তিবর্গকেই পুরস্কার দুটো দেওয়া হচ্ছিল। ফলে, ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ এতটাই সম্মানজনক হয়ে উঠেছিল যে, একে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক হিশেবে গণ্য করা হতে থাকে। কিন্তু জীবনের শেষপ্রান্তে এসে জিয়াউর রহমান ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’কে একটা বিচিত্র উপায়ে কলুষিত করেন। ১৯৮০ সালে তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ দেন পিরোজপুরের ছারছিনা দরবার শরিফের পির আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহকে। আবু জাফর বৃহত্তর বরিশালের মুখ্য স্বাধীনতাবিরোধীদের একজন। অর্ধসহস্রাধিক রেজাকার, দালাল ও সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর তিনি মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন, যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী তাকে গৃহবন্দি করে রাখে। ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি তাকে গ্রেপ্তার করে বরিশালে নিয়ে যাওয়া হয়। আবু জাফর দালাল আইনে জেল খাটতে থাকেন এবং শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষিত হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে জেল থেকে ছাড়া পান। আবু জাফরের যুদ্ধাপরাধের বর্ণনা পাওয়া যায় ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ বইয়ে (পৃষ্ঠা ৯১-৯৪)। যে পুরস্কারের নামের সাথে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটা জড়িয়ে আছে, দালাল আইনে জেল খাটা একজন স্বাধীনতাবিরোধীর হাতেও সেই ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ তুলে দিতে জিয়া দ্বিধাবোধ করেননি।

একই সালে (১৯৮০) সাহিত্যে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ দেওয়া হয় কবি ফররুখ আহমদ ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরীকে। ফররুখ চল্লিশের দশকের অত্যন্ত শক্তিমান কবি, তার কাব্যপ্রতিভা নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। কিন্তু তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি। তিনি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতা করেছিলেন, জামায়াতে ইসলামির মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম’-এ ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসরদেরকে উৎসাহ দিয়ে কবিতা লিখেছেন, যুদ্ধের পর বাংলা অ্যাকাডেমিতে তার প্রবেশ অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল। সদ্য স্বাধীন দেশে, ১৯৭৪ সালে, মৃত্যুর পর তার মরদেহ দাফন নিয়েও জটিলতা সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত শাহজাহানপুর কবরস্থানে কবি বেনজির আহমেদের কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয় (বেনজিরও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন)। অপরপক্ষে মুনীর চৌধুরী একজন শহিদ বুদ্ধিজীবী। জামায়াতে ইসলামির তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ছাত্রসংঘের কিলিং স্কয়াড আল-বদর বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর যেসব বুদ্ধিজীবীদেরকে অপহরণ করে নিয়ে হত্যা করে, মুনীর চৌধুরী তাদের অন্যতম। জিয়াউর রহমান একজন শহিদ বুদ্ধিজীবীকে যে মঞ্চে পুরস্কৃত (মরণোত্তর) করেছেন, সেই একই মঞ্চে পুরস্কৃত করেছেন দুজন স্বাধীনতাবিরোধীকেও। সেদিন মুনীর চৌধুরীর পক্ষে কেউ পুরস্কার গ্রহণ করতে গিয়েছিলেন কি না, গিয়ে থাকলে তার অনুভূতি কী হয়েছিল— জানি না। এটুকু জানি— জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে একটা অদ্ভুত ও জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিলেন। একই রাষ্ট্রপতি একই মঞ্চে শহিদ বুদ্ধিজীবীকেও পুরস্কৃত করছেন, আবার দালাল আইনে জেল খাটা যুদ্ধাপরাধীকেও পুরস্কৃত করছেন— সম্ভবত বিশ্ব-ইতিহাসেই এ এক নজিরবিহীন নৃত্যনাট্য। উল্লেখ্য, ‘পল্লি উন্নয়নে অসাধারণ অবদানের জন্য’ ১৯৭৭ সালে মাহবুব আলম চাষীকে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ দেন জিয়াউর রহমান। এই মাহবুব আলম চাষী শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত শীর্ষ ষড়যন্ত্রকারীদের একজন হিশেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছেন।

১৭.
জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতেও সেসব কর্মকর্তাকে উচ্চপদে আসীন করেছিলেন এবং দ্রুত পদোন্নতি দিয়েছিলেন; যারা মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়জুড়ে পাকিস্তানে ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধশেষে বাংলাদেশে ফিরেছেন। উদাহরণস্বরূপ— ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে সেনাপ্রধান হিশেবে নিয়োগ দেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে-সাথে এরশাদ পাকিস্তানে পাড়ি জমিয়েছিলেন, বাংলাদেশে ফিরেছিলেন ১৯৭৩ সালে। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধে বিন্দুমাত্র ভূমিকা না-থাকা এরশাদকেই সেনাপ্রধান হিশেবে জিয়ার পছন্দ হয়েছিল। সেনাকর্মকর্তাদের মধ্যে যারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, জিয়া তাদের পদোন্নতির ব্যাপারে উৎসুক ছিলেন না। অ-মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দ্রুত পদোন্নতিপ্রদান এবং মন্ত্রিসভায় স্বাধীনতাবিরোধীদেরকে স্থান দেওয়া ছিল জিয়ার বিরুদ্ধে ১৯৮১ সালের মে মাসে বিদ্রোহ হওয়ার অন্যতম কারণ। জিয়া সেই বিদ্রোহে নিহত হন। বিদ্রোহের পেছনে এমন কারণ থাকার কথা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহম্মদ ইব্রাহিম (৩০ মে ২০২২)। জিয়াহত্যায় অভিযুক্ত সেনাকর্মকর্তারা বিদ্রোহপরবর্তী সামরিক আদালতে এই তথ্য দিয়েছেন।

জেনারেল জিয়াউর রহমানের যুদ্ধাপরাধী পুনর্বাসনপ্রক্রিয়া আরেক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও অব্যাহত রেখেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি খন্দকার আবদুর রশিদ, সৈয়দ ফারুক রহমান ও বজলুল হুদা ১৯৮৭ সালে এরশাদের আমলেই ফ্রিডম পার্টি নামে একটা রাজনৈতিক দল গঠন করেন। অর্থাৎ এরশাদই শেখ মুজিবের খুনিদেরকে বাংলাদেশে সংঘবদ্ধ রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। ফ্রিডম পার্টি পরিচালিত হতো লিবিয়ায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মুয়াম্মার গাদ্দাফির অর্থায়নে। দল গঠন করার আগ পর্যন্ত এই খুনিদের একাংশ দেশছাড়া ছিলেন। এরশাদই তাদেরকে দেশে ফেরার সুযোগ করে দেন। ১৯৮৬ সালে এরশাদ সৈয়দ ফারুক রহমানকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করারও সুযোগ দেন। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে মেহেরপুর থেকে বজলুল হুদা সাংসদও নির্বাচিত হন। অর্থাৎ শেখ মুজিবের খুনিরা এরশাদের আমলে জাতীয় সংসদেও চলে যায়। এরশাদও শেখ মুজিবের হত্যাকারীদেরকে বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে বহাল রাখেন, কাউকে-কাউকে পদোন্নতিও দিয়েছেন। ইনকিলাব পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা আবদুল মান্নানকে এরশাদ মন্ত্রিত্ব দিয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান মাদ্রাসাশিক্ষক সমিতির সভাপতি হিশেবে মাদ্রাসাশিক্ষকদের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে ১৯৭১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মান্নান জেনারেল নিয়াজির সাথে দেখা করেন। নিয়াজিকে এক কপি কোরান উপহার দিয়ে মান্নান বলেছিলেন— ‘পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও ইসলামের গৌরব বৃদ্ধির জন্য আমরা সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।’ এই বৈঠকের পর মাদ্রাসাশিক্ষক ও ছাত্রদেরকে রেজাকার, আল-বদর ও আশ-শামসে অন্তর্ভুক্ত করে সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। মান্নান-সংক্রান্ত উল্লিখিত তথ্যের উৎস ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ বইয়ের পৃষ্ঠা ৮৮-৯০। ইতিহাসের বড় ট্রাজেডি হলো— শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদেরকে আশির দশকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল গঠন করার সুযোগ করে দেওয়া এরশাদকে ২০১৪ সালে মন্ত্রীপদমর্যাদায় নিজের ‘বিশেষ দূত’ হিশেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানেরই জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা।

১৯.
যা হোক, স্বাধীনতাবিরোধী পুনর্বাসনপ্রক্রিয়ায় খন্দকার মোশতাক আহমেদ, জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পদাঙ্কই অনুসরণ করেন সংসদীয় গণতন্ত্র চালুর পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়া— বিএনপিপ্রধান বেগম খালেদা জিয়া। ১৯৯১ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামির প্রত্যক্ষ সমর্থনেই সরকার গঠন করেন। ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি জামায়াতে ইসলামির সাথে জোটবদ্ধ হন এবং নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে পুরস্কার হিশেবে জামায়াতকে দুটো মন্ত্রিত্ব দেন। মন্ত্রিত্ব পাওয়া দুজনই একাত্তরে আল-বদরের শীর্ষ নেতা ছিলেন, নৃশংসতায় যে আল-বদর ছিল ক্ষেত্রবিশেষে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চেয়েও ভয়াবহ। খালেদা জিয়া জামায়াতের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামীকে বানান কৃষিমন্ত্রী পরে (শিল্পমন্ত্রী), সেক্রেটারি জেনারেল আলি আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে সমাজকল্যাণমন্ত্রী। যুদ্ধাপরাধের দায়ে নিজামী-মুজাহিদ দুজনেই পরবর্তীকালে অবশ্য মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীরা বিভিন্ন শাসনামলে ব্যক্তিগতভাবে মন্ত্রী হয়েছেন। জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বেগম খালেদা জিয়া— তিনজনই যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা ওড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো স্বাধীনতাবিরোধী দলকে খালেদা জিয়াই প্রথম রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার করেছেন। উল্লেখ্য, যুদ্ধাপরাধের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডভোগরত অবস্থায় ২০১৪ সালে মারা যাওয়া আবদুল আলিম ১৯৯৬ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপির টিকেটে সাংসদ ছিলেন, জিয়াউর রহমানের আমলে প্রথমে ছিলেন পাটমন্ত্রী ও পরে যোগাযোগমন্ত্রী।

২০.
জিয়াউর রহমানের পাটমন্ত্রী ছিলেন আবদুর রহমান বিশ্বাস। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর খালেদা জিয়া প্রথমে তাকে জাতীয় সংসদের স্পিকার বানান, পরে বানান রাষ্ট্রপতি। একাত্তরে রহমান ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল মুসলিম লিগের একাংশের বরিশাল জেলা কমিটির সহ-সভাপতি। রহমান প্রকাশ্যে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেন এবং একাত্তরের জুলাই মাসে শান্তি কমিটির সভায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করেন। রাষ্ট্রপতি আইনানুগভাবে বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। আবদুর রহমান বিশ্বাস রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল আর জামায়াতে ইসলামির ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির ছাড়া আর কোনো ছাত্রসংগঠন রহমানের মতো একজন স্বাধীনতাবিরোধীকে দেশের রাষ্ট্রপতি তথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য হিশেবে মেনে নেয়নি। মিছিল-মিটিং করে ছাত্রসমাজ এর প্রতিবাদ করেছিল এবং পুলিশ ছাত্রদেরকে যথারীতি পিটিয়ে প্রতিবাদ ভণ্ডুল করে দিয়েছিল। এর পর রহমান রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন নীরবে-নিভৃতে। ছাত্ররা আবারও বিক্ষোভ করতে পারে— এই আশঙ্কায় আবদুর রহমান বিশ্বাসের কর্মকাণ্ডের খবরাখবর গণমাধ্যমে খুব-একটা প্রচারিত হতো না।

২১.
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী চট্টগ্রামের একজন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে হেয় করে যত কথা একজীবনে বলেছেন, বাংলাদেশে আর কেউ তা বলেছেন বলে মনে হয় না। দেশের সবচেয়ে দাম্ভিক ও উদ্ধত রাজনৈতিক নেতা ছিলেন তিনি। অশ্লীল কথাবার্তায়ও তার জুড়ি ছিল না। যুদ্ধাপরাধের দায়ে ২০১৫ সালে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। সালাউদ্দিন জিয়াউর রহমানের আমলেও বিএনপির টিকেটে সাংসদ হয়েছেন, সাংসদ হয়েছেন খালেদা জিয়ার মনোনয়নেও। খালেদা তাকে নিজের সংসদবিষয়ক উপদেষ্টাও বানিয়েছিলেন। ২০০১ সালে সালাউদ্দিন গোঁ ধরেছিলেন ওআইসির মহাসচিব পদে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রার্থী হওয়ার জন্য। খালেদা তাতে সম্মতিও দিয়েছিলেন। কথিত আছে— ২০০ কোটি টাকা খরচ করে দেশ-বিদেশে তদবির করেও সালাউদ্দিনকে জেতানো যায়নি। উলটো মালয়েশিয়ার সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হয়েছিল, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশীদের শ্রমবাজারের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল; কারণ ওআইসির সেই নির্বাচনে মালয়েশিয়ারও প্রার্থী ছিল, বাংলাদেশ নিজেরা প্রার্থী না দিয়ে মালয়েশিয়ার প্রার্থীকে সমর্থন দিলে মালয়েশিয়ার সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বজায় থাকত। যা হোক, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও একজন যুদ্ধাপরাধীকে প্রতিনিধিত্ব করতে পাঠাতে খালেদা জিয়া দ্বিধাবোধ করেননি। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ওআইসির মহাসচিব হয়ে গেলে বিশ্বপরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতেন একজন যুদ্ধাপরাধী।

২২.
শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজম আদালতের রায়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ফিরে পান ১৯৯৪ সালে, খালেদা জিয়ার আমলেই। ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৪— পাকিস্তানের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও এই ষোলো বছর আজম বেআইনিভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করেন। ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর খবর আসে— গোলাম আজমকে জামায়াতে ইসলামির আমির ঘোষণা করা হয়েছে। একজন পাকিস্তানি নাগরিককে বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের সভাপতি করা হলো— এর প্রতিবাদে জনবিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেন শহিদজননী জাহানারা ইমাম। আজমকে জামায়াতে ইসলামির আমির ঘোষণার তিন সপ্তাহের মাথায় দেশের ১০১ বিশিষ্ট নাগরিকের সমন্বয়ে ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠিত হয়, জাহানারা ইমামকেই নির্মূল কমিটির প্রধান করা হয়। কমিটি ঘোষণা দেয়— (১৯৯২ সালের) ২৫ মার্চের মধ্যে সরকার গোলাম আজমের বিচার না করলে ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে (রেসকোর্স ময়দান) গণআদালত বসিয়ে আজমের বিচার করা হবে। জামায়াত-সমর্থিত বিএনপি সরকার, অনুমিতভাবেই, নির্মূল কমিটির মিছিল-মিটিংয়ে পুলিশ দিয়ে হামলা করে; সেই হামলায় খোদ জাহানারা ইমাম আহত হয়ে পিজি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। যে শহিদদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশরাষ্ট্র কায়েম হয়েছিল, একজন পাকিস্তানি নাগরিককে দেশের একটি রাজনৈতিক দলের সভাপতি করার প্রতিবাদ করতে গিয়ে সেই শহিদদেরই একজনের মাকে খালেদা জিয়ার আমলে আহত-লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল। গণআদালত বসানোর অপরাধে তৎকালীন বিএনপি সরকার জাহানারা ইমামসহ চব্বিশজন বিশিষ্ট নাগরিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা মাথায় নিয়েই জাহানারা ইমাম ১৯৯৪ সালে মিশিগানে মৃত্যুবরণ করেন। শারীরিক হামলার পর রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা ছিল জাহানারা ইমামের জন্য বিএনপির শেষ উপহার।

২৩.
আসিফ নওয়াজ জানজুয়া ১৯৭১ সালে পাক সেনাবাহিনীর মেজর ছিলেন। বাংলাদেশে পরিচালিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যায় তিনি সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ আছে। জানজুয়া পরবর্তীকালে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হন এবং সেনাপ্রধান থাকাকালেই ১৯৯৩ সালের ৮ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। অন্য দেশের সেনাপ্রধানের মৃত্যুতে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের শোকপ্রকাশের রেওয়াজ নেই। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রচলিত রেওয়াজ ভেঙে জানজুয়ার মৃত্যুতে আনুষ্ঠানিকভাবে শোকপ্রকাশ করেছেন। এই শোকপ্রকাশের খবর পরেরদিনের (৯ জানুয়ারি ১৯৯৩) জাতীয় পত্রিকাগুলোয় (যেমন— ইত্তেফাক, সংবাদ, অবজারভার) ছাপা হয়। আবার, যে জগজিৎ সিং অরোরার নেতৃত্বাধীন মিত্রবাহিনীর কাছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে, সেই অরোরার মৃত্যুর সময়েও (২০০৫ সাল) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খালেদা জিয়াই। কিন্তু জেনারেল অরোরার মৃত্যুতে বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিশেবে আনুষ্ঠানিকভাবে বা ব্যক্তি হিশেবে অনানুষ্ঠানিকভাবে কোনো শোকপ্রকাশ করেননি। পাকিস্তানি সেনাপ্রধানের মৃত্যুতে প্রটোকল ভেঙে প্রধানমন্ত্রীর শোকপ্রকাশ, অথচ মুক্তিযুদ্ধের মিত্রবাহিনীর মৃত্যুতে একই প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা— এ নিয়ে নিশ্চয়ই চিন্তাভাবনার প্রয়োজন আছে।

২৪.
মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক কিছু না, সংখ্যায় সামান্য হেরফের হতেই পারে। তবে, এই প্রশ্ন যারা অদ্যাবধি তুলেছেন, রাজনৈতিক পরিচয় খতিয়ে দেখলে এটাও আবার সুস্পষ্টভাবে ধরা দেয়— এই প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের কারো উদ্দেশ্যই মহৎ না, প্রত্যেকেরই দুরভিসন্ধি আছে। মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা যত কম দেখানো যাবে; পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংসতা তত কম বলে প্রতিষ্ঠিত হবে, তাদের সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের মাত্রা তত ক্ষীণ বলে পরিগণিত হবে, দেশীয় দোসররাও পাবে বিশাল দায়মুক্তি। বিএনপি-নেতারা বরাবরই আকারে-ইঙ্গিতে বলে থাকেন— মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ত্রিশ লাখ না, তিন লাখ। মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ত্রিশ লাখ হলে তাতে বিএনপির কোনো ক্ষতি নেই, তিন লাখ হলে তাতেও বিএনপির কোনো লাভ নেই। তিন লাখ হলে লাভ আছে পাকিস্তানের, সেক্ষেত্রে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ-দেশীয় দোসররা নয়-দশমাংশ দায়মুক্তি পেয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিএনপি ১৯৯১ সালে খোদ সংসদেই বিতর্ক তুলেছে, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সেই বিতর্ককে ফের উসকে দিয়েছেন স্বয়ং খালেদা জিয়া। অর্থাৎ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে নিরপরাধ বা কম-অপরাধী প্রমাণ করার কোনো চেষ্টাই বিএনপি বাদ রাখেনি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, খালেদা জিয়ার প্রথম মন্ত্রিসভার পরিবেশ ও বনপ্রতিমন্ত্রী গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আরেক কাঠি বেশি সরেস। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও আল-বদর বাহিনীর হাতে নিহত হওয়া বুদ্ধিজীবীদেরকে নিয়ে ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর অত্যন্ত ঔদ্ধত্যের সাথে গয়েশ্বর বলেন— ‘যারা পাকিস্তানের বেতন-ভাতা খাইছে, শেষদিন পর্যন্ত, তারা নির্বোধের মতো মারা গেল। আমাদের মতো নির্বোধেরা প্রতিদিন তাদেরকে শহিদ বুদ্ধিজীবী হিশেবে ফুল দেয়। না গেলে আবার পাপ হয়। ওনারা যদি এত বুদ্ধিমান হন, তাহলে ১৪ তারিখ পর্যন্ত নিজের ঘরে থাকে কী করে, একটু বলেন তো। আর তা ছাড়া, নিজ-নিজ কর্মস্থলে প্রতিমাসে পাকিস্তানের বেতন খাইল, এটাও তো কথা বলা যায়, যায় না? তারা পাকিস্তান সরকারের বেতন খাইল, তারা হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধা। আর যারা পালায়ে-পালায়ে না খেয়ে বেড়ালো, তারা হয়ে গেল রেজাকার। তাই না? যারা ২৫ মার্চ মারা গেছেন, তারা মারা গেছেন না জানার কারণে। আর যারা ১৪ ডিসেম্বর মারা গেছেন, তারা অজ্ঞতার কারণে মারা যাননি। তাঁরা জ্ঞাতসারে অবস্থান করছিলেন।’ শহিদ বুদ্ধিজীবীদেরকে নিয়ে এসব উক্তি করা ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের না বিপক্ষের— তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মুক্তিযুদ্ধ ইশুতে বিএনপি-নেতারা সাধারণত এই ভাষায়ই কথা বলে থাকেন, পোষণও করেন প্রায় একই মানসিকতা। গয়েশ্বর রায়ের এই মন্তব্য সম্পর্কে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন— ‘গয়েশ্বর রায় পাকিস্তানিদের জবান ধার করে কথা বলেছেন। সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো মানুষ এ কথা বলতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষকেই কি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যেতে হতো? এ দেশের বুদ্ধিজীবীসমাজ এখানে থেকেই প্রতিরোধ করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন, লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তারা পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেননি।’

২৫.
আবদুল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগে যে গণজাগরণ হয়েছিল, শুরু থেকেই বিএনপি এর সক্রিয় বিরোধিতা করে এবং গণজাগরণে অংশগ্রহণকারীদেরকে নিয়ে কটাক্ষ করতে থাকে। খোদ খালেদা জিয়া তাদেরকে নষ্ট-ভ্রষ্ট ও ফ্যাসিস্ট বলে বিষোদগার করেন। বিএনপিপন্থি দৈনিক পত্রিকা ‘আমার দেশ’ গণজাগরণকে ধূলিসাৎ করার পাঁয়তারা নিয়ে নামে এবং সেই উদ্দেশ্যে অনেকটা সফলও হয়। ‘আমার দেশ’-এর অব্যাহত কুৎসা আর ব্যক্তিগত আক্রমণে শাহবাগের তারুণ্য খানিকটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। গণজাগরণকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য বিএনপি-জামায়াত ২০১৩ সালের ৫ মে উগ্রবাদী সংগঠন ‘হেফাজতে ইসলাম’-কে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ডেকে এনে সমাবেশ করিয়েছিল এবং দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতেও সক্ষম হয়েছিল। উল্লেখ্য হেফাজতের কোনো নেতা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি; ধর্মভিত্তিক যেসব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে হেফাজত গঠিত, সেসব দলও মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে কোনো ভূমিকা পালন করেনি। পরবর্তীকালে কখনও আওয়ামি লিগ সরকার হেফাজতের সাথে আপস করেছে, আবার কখনও হেফাজত আওয়ামি লিগ সরকারের সাথে আপস করেছে। শেষ পর্যন্ত তরুণদের দাবি পূরণ যেমন হয়েছে, ইতিহাসে তেমনি লেখা থাকবে— বিএনপি ১৯৯২ সালের গণআদালতকেও গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল ২০১৩ সালের গণজাগরণও। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের জন্য যা যা করা সম্ভব, ১৯৭৫ থেকে শুরু করে অদ্যাবধি বিএনপি এর সবকিছুই করেছে।

২৬.
আরেকটা কম আলোচিত স্বাধীনতাবিরোধী ঘটনা খালেদা জিয়ার আমলে সংঘটিত হয়েছে। এক কালে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের নাম ছিল এমএ হান্নান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। হান্নান একাত্তরে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামি লিগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং আওয়ামি লিগের দাবি অনুযায়ী— তিনি চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা প্রথম পাঠ করেন। সে হিশেবে তিনিই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক। কিন্তু বিএনপির দাবি— স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান (যদিও জীবদ্দশায় জিয়া নিজেকে কখনোই স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি)। স্বাধীনতার ঘোষণার কৃতিত্বের ভাগাভাগিতে এমএ হান্নান যেহেতু জিয়াউর রহমানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, সেহেতু ২০০৫ সালের এপ্রিল মাসে তৎকালীন বিএনপি সরকার এমএ হান্নান বিমানবন্দরের নাম পালটে ফেলে। নতুন নাম রাখে শাহ্ আমানত বিমানবন্দর। এখন দুটো ছাত্রাবাস থাকলেও তখন হান্নানের নামে বিমানবন্দর ছাড়া আর কিছুই ছিল না। বিমানবন্দর থেকে হান্নানের নাম মুছে দিয়ে বিএনপি হান্নানকে ইতিহাস থেকে বিলুপ্ত করে দিতে চেয়েছিল।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান একজন ‘বীরউত্তম’ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। দেশে ঝাঁকে-ঝাঁকে বীরউত্তম নেই। মাত্র আটষট্টিজন মুক্তিযোদ্ধা এই খেতাব পাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডারও। ১৯৭১ সালের ২৬ ও ২৭ মার্চ রেডিওতে যারা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন, জিয়া তাদেরও একজন। কিন্তু সেনাপ্রধান, প্রধান সামরিক আইনপ্রশাসক বা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সাথে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানকে মেলানো কষ্টকর। একাত্তরে তিনি যে-দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন, তার পঁচাত্তরপরবর্তী কর্মকাণ্ড সেই দেশের মৌলিক আদর্শের সাথে কোনোক্রমেই সামঞ্জস্যপূর্ণ না। বিএনপিতে মুক্তিযোদ্ধারা যেমন ছিলেন-আছেন, তেমনি ছিল যুদ্ধাপরাধীদেরও অবাধ আনাগোনা। বিএনপিতে থাকা মুক্তিযোদ্ধা নেতারাও অবশ্য যুদ্ধাপরাধীদের ভাষায়ই কথা বলেন। জিয়াউর রহমানকে ঘিরে যুদ্ধাপরাধীরা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল, পঁচাত্তরপরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীনতাবিরোধীদের আশাভরসার কেন্দ্রস্থল। মায়ের কোলে শিশু যেমন নিরাপদ, জিয়াও তেমনি স্বাধীনতাবিরোধীদের জন্য নিরাপদ ক্লাব বনে গিয়েছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরোধিতা করতে গিয়ে জিয়াউর রহমান কখন যে বাংলাদেশেরই বিরোধী হয়ে উঠেছিলেন, তা হয়তো তিনি নিজেও টের পাননি। জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানও বাবা-মায়ের পদাঙ্কই অনুসরণ করেছেন। ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব লন্ডনের এক আলোচনাসভায় তারেক শেখ মুজিবকে খুনি, রেজাকার, পাকবন্ধু ও অবৈধ রাষ্ট্রপতি বলে আখ্যা দেন এবং মুজিবের মরণোত্তর বিচার হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন।

শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের বিচারবন্ধে প্রণীত দায়মুক্তি অধ্যাদেশ সংসদে অনুমোদন, মুজিবের খুনিদেরকে পুরস্কৃতকরণ, মুজিবকে ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা, দালাল আদেশ বাতিল, কারাবন্দি অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদেরকে ছেড়ে দেওয়া, যুদ্ধাপরাধীদের ভোটাধিকার ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ ফিরিয়ে দেওয়া, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি উন্মুক্ত করে দেওয়ার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠনগুলোকে রাজনীতিতে পুনর্বাসন, স্বাধীনতাবিরোধীদেরকে মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী বানানো ও ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রদান, গোলাম আজমকে বাংলাদেশে আসার ভিসা দেওয়া এবং বেআইনিভাবে বছরের পর বছর দেশে থাকতে দেওয়া, সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল, ‘জয় বাংলা’র পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’কেই আপন মনে করা— একজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে এসব কর্মকাণ্ড সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব পাঠকের। যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতে ইসলামিকে ক্ষমতার অংশীদার করা, দুই শীর্ষ আল-বদর নেতাকে মন্ত্রিত্বপ্রদান, আরেক স্বাধীনতাবিরোধীকে স্পিকার ও রাষ্ট্রপতি বানানো, কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীকে ওআইসির মহাসচিব পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দেওয়া এবং তাকে নিজের উপদেষ্টা বানানো, শহিদজননীর নামে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের, দেশের স্থপতির হত্যাকাণ্ডের দিন নিজের ভুয়া জন্মদিন পালন, মুক্তিযুদ্ধের শহিদসংখ্যা নিয়ে উদ্দেশ্যমূলক বিতর্কের জন্মদান, শহিদ বুদ্ধিজীবীদেরককে নির্বোধ আখ্যা-দান, পাকবন্ধু আখ্যা দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের মরণোত্তর বিচার চাওয়া— এসব কর্মকাণ্ডও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের কোনো দলের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্বও পাঠকের। উল্লিখিত কার্যকলাপের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদেরকে বা তাদের দলকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের বলে স্বীকৃতি দেওয়ার সুযোগ আছে কি না— সেই উপসংহার টানার দায়ও পাঠকের ওপরই বর্তায়।

সব লেখার উপসংহার যে লেখকই টানবেন, ইতিহাসের সব রায় লেখকই দেবেন— এমন না। কিছু উপসংহার পাঠককেও টানতে হয়, কিছু রায় পাঠককেও দিতে হয়।

২৬-২৮ আগস্ট ২০২৩

Related Posts