কঠিন পরিণতির দিকে বাংলাদেশের রাজনীতি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে ততই নিজ নিজ অবস্থানে কঠোর হচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। আওয়ামী লীগের অবস্থা এমন যে, যতই চাপ আসুক এবং ঠেকানোর চেষ্টা হোক ২০১৪ সালের মতো প্রশাসনকে ব্যবহার করে তারা নির্বাচনের আয়োজন করবেই। আর বিএনপির অবস্থা হচ্ছে নির্দলীয় সরকারের অধীন ছাড়া নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। এতে যতই জুলুম-নির্যাতন-হামলা-মামলা হোক নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। দুই দলের এই যুদ্ধংদেহী কঠোর অবস্থানে চোখ রাখছে আন্তর্জাতিক মহল। তারাও চায় সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন। গত ২৭ আগস্ট ১০৬ জন নোবেল বিজয়ীসহ যে ১৮৪ জন বিশ্বনেতা ড. ইউনূসের বিচার ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খোলা চিঠি দিয়েছেন সে চিঠিতে স্পষ্ট করে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে সম্প্রতি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি যে হুমকি দেখছি, তাতে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা বিশ্বাস করি, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া এবং নির্বাচনকালীন প্রশাসন দেশের সব বড় দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগের ২টি জাতীয় নির্বাচনে (২০১৪ ও ২০১৮) গ্রহণযোগ্যতার অভাব ছিল।’

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের আগ্রহের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলের আগ্রহ প্রবল হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘ জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন ইস্যুতে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে মুখিয়ে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ থেকে তৈরী পোশাক ক্রয় বন্ধ করে দিলে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে দেশ। চরম পরিণতির মুখে ধাবিত হবে শিল্প-বাণিজ্য-অর্থনীতি। চরম এই বাস্তবতা তথা সুনামির আগাম বার্তা জানার পরও সংবিধানের দোহাই দিয়ে এককভাবে নির্বাচনের পথে হাঁটছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আন্তর্জাতিক মহলকে থোরাইকেয়ার করে ক্ষমতাসীনদের এই নির্বাচনের পথে অগ্রসরের মূলে রয়েছে কিছু হাইব্রিড নেতা। এদের মধ্যে রয়েছে কিছু শিল্পপতি-ব্যবসায়ী, আমলা, পুলিশ প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তাÑকিছু বাম নেতা (যারা এককভাবে নির্বাচন করলে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার হতে পারবেন না) আর কিছু হঠাৎ সাড়ে ১৪ বছরে ফুলেফেপে ওঠা হাইব্রিড নেতা। এদের কাছে দেশের সর্বনাশের চেয়ে নিজেদের অবৈধপথে উপার্জিত অর্থবিত্ত রক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এসব হাইব্রিডের আশঙ্কা আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় আসতে না পারলে তাদের চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে।

‘বাংলাদেশের জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে আন্তর্জাতিক মহলও কঠোর অবস্থানে’ এত দিন ইউটিউবের ‘গুজব’ অভিহিত করে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এসব নিয়ে বিস্তর লেখালেখি-মতামত-বিতর্ককে অহেতুক বাগড়ম্বর হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহল যে খুবই তৎপর তা দৃশ্যমান। মূলত বাংলাদেশের গণতন্ত্র তথা জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহল জড়িয়ে গেছে। জাতিসংঘের একের পর এক বিবৃতি, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি, প্রভাবশালী দেশটির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ঘন ঘন ঢাকা সফর সে বার্তাই দেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঢাকায় দায়িত্বশীল কূটনীতিকরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ, পেশাজীবী, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা এমনকি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকে পরিষ্কার তারা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ওয়াকিবহাল। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এত আগ্রহী ছিল না। কিন্তু এবার দেশটি বাংলাদেশে আন্তর্জাতিকমানের নির্বাচন দেখতে চায় এবং এ লক্ষ্যে চাপ দিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষে দৌড়ঝাঁপ করছে এবং তারা জানিয়েছে নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে জিএসপি প্লাস সুবিধা দেবে; পাতানো নির্বাচন হলে কঠোর অবস্থানে যাবে। জাপানের সাবেক রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মতো রাতের ভোট হয় এমন কথা তিনি কোথাও শুনেননি’। রাশিয়া যুদ্ধের কারণেই বাংলাদেশ নিয়ে মাথা ঘামানোর অবস্থায় নেই। চীন ব্যবসায়িক কারণে তাদের মতো করেই সমর্থন দেবে। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা শিং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার পাতানো নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টিকে অংশগ্রহণে বাধ্য করেছিলেন। ২০১৮ সালের রাতের ভোটের নির্বাচনের পর নরেন্দ্র মোদি সরকার আন্তর্জাতিক মহলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে দূতিয়ালি করেছে। যার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘ভারতকে যা দিয়েছি তারা সারাজীবন মনে রাখবে’। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছিলেন, ‘ভারতে গিয়ে বলেছি শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে যা যা করা প্রয়োজন করতে হবে’। এবার ভারত কিন্তু সে অবস্থানে নেই। ভারতের বুদ্ধিজীবীরা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ভিসা নীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারত দূতিয়ালি করবে না’। ভারতের কিছু গণমাধ্যমে ‘ফরমায়েশি’ প্রতিবেদন প্রকাশের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত কোনো দলকে সমর্থন করবে না’। তারপরও বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে ভারতের ভূমিকা রহস্যজনক। ফলে সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে না পারলে বাংলাদেশের কী পরিণতি হবে তা সহজেই অনুমেয়। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই কয়েকটি দেশের বিতর্কিত নির্বাচনের কারণে সেসব দেশে ‘ভিসা নীতি’ ‘স্যাংশন’, নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তারপরও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা ২০১৪ সালের মতো বিএনপিকে সাইড লাইনে রেখে নির্বাচনের পথে হাঁটছে।

নির্বাচনের আয়োজন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান গণমাধ্যমকে জানান, তিনি মনেই করেন না দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনে আয়োজনে কোনো অসুবিধা হবে। তিনি বলেন, আমি মনে করি এখন নির্বাচন চলে আসছে। নির্বাচন নিয়ে তেমন চাপ নেই। চাপ হলো ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার নির্বাচন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সেটাই চান। তিনি আগেই বলে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক যত পর্যবেক্ষক আসতে চায় আসুক। আগে থেকেই ধরে নেয়া উচিত হবে না সে ভোট ফ্রি ফেয়ার হবে না। এটা ঠিক না। বন্ধু দেশগুলো নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলেছেন। আমার মনে হয় না এবার নির্বাচনের আয়োজনে কোনো অসুবিধা হবে। তবে অসুবিধা হলো বিএনপি এখনো বলছে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। না হলে ভোট হতে দেবে না। ওবায়দুল কাদের ইতোমধ্যেই বিএনপিকে ভোটে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমরা পরিবেশ সৃষ্টি করছি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে হাইব্রিড নেতা হিসেবে পরিচিত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ গতকাল বলেন, একটি বা দু’টি দল যদি জাতীয় নির্বাচনে না আসে, তাহলেও নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক না বলার সুযোগ নেই। কারণ নিবন্ধিত আরো অনেক দল নির্বাচনে আসবে।

টানা তিন মেয়াদে সরকারে থাকায় ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগের অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, দলটি কার্যত হাইব্রিডে আটকে গেছে। ইচ্ছা করলেই দলটি এখন হাইব্রিডের মতামতের বাইরে গিয়ে ‘দেশ ও জনগণের পক্ষে’ বাস্তদবাদী পথে হাঁটতে পারছে না। ফলে দলটির প্রবীণ ও পরীক্ষিত দেশপ্রেমী নেতারা হাইব্রিডের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। গত ৭ জুন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু বলেছিলেন, ‘প্রয়োজনে আওয়ামী লীগ জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থতায় উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়েছিল, যদিও শেষ পর্যন্ত তাতে কোনো সমাধান আসেনি। এবার বিএনপি তাদের প্রস্তাব দিক সঙ্কট সমাধানের জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় আলোচনা হবে’। ১৪ দলীয় জোটের একটি সমাবেশে একই বক্তব্য দেয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে তাকে বলতে হয়েছে ‘কিসের সংলাপের দাওয়াত, বিএনপিকে কি বিয়ের দাওয়াত দেবো?

আওয়ামী লীগ কার্যত জনগণ এবং আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত নেতাকর্মী নয়, কার্যত ব্যবসায়ী-কাম-হাইব্রিড নেতা, আমলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। করোনাকালে দলীয় নেতাদের বদলে আমলাদের দিয়ে ত্রাণ বিরতণ করা হয়েছে। আমলাদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় অনেক নেতাই ‘নীরব’ হয়ে গেছেন। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে সুবিধাভোগী একঝাঁক ব্যবসায়ী। তারা টাকা দিয়ে দলীয় নমিনেশন বাগিয়ে নিয়ে এমপি হচ্ছেন, মন্ত্রী হচ্ছেন, মেয়র হচ্ছেন আর যাদের এমপি-মন্ত্রী হওয়ার কথা তারা পড়ে থাকছেন সাইড লাইনে। এদের একটি অংশ ব্যবসার এবং নানাভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করেছেন এবং কেউ কেউ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন। পানামা পেপার্সে বাংলাদেশিদের বিদেশে টাকা পাচার, সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের তালিকা প্রকাশ এবং দুবাইতে কানাডার ‘বেগম পল্লী’র মতো ‘বাংলাদেশ পল্লী’ গড়ে ওঠা নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হওয়ার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছিলেন, ‘আমার কাছে তথ্য রয়েছে বিদেশে যারা টাকা পাচার করেছে তাদের মধ্যে রাজনীতিকের সংখ্যা কম। ব্যবসায়ী এবং সরকারি চাকরিজীবী তথা আমলার সংখ্যা বেশি।’ তিনি বিদেশে টাকা পাচারকারীদের ৩২ জনের মধ্যে ২৮ জন ব্যবসায়ী ও আমলা বলে জানিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের দু’জন নেতা প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে কারাগারে রয়েছেন। জেলা পর্যায়ের ছাত্রলীগের নেতাদের এই অবস্থা হলে অন্যদের অবস্থা কেমন তা সহজেই অনুমেয়। শুধু কী তাই! গত ১৫ জুলাই ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ সংগঠন ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিশেষ সম্মেলনের আয়োজন করে ঘোষণা দিয়েছেন তারা আবারও শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় দেখতে চান। ওই সম্মেলনে ৩২ জন ব্যবসায়ী-শিল্পপতি বক্তৃতা দেন। তাদের মধ্যে ৩১ জন শেখ হাসিনাকে ফের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করতে যা যা করা দরকার করবেন এমন অঙ্গীকার করেন। এমনকি কিছু মুখচেনা ব্যবসায়ী বিএনপির বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার স্লোগান দেন, গান, কবিতা আবৃতি করেন। এই সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী, আমলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে কর্মরত বিতর্কিত কর্মকর্তা এবং সাড়ে ১৪ বছরে যারা শত শত কোটি টাকা লুটপাট করেছেন তারাই মূলত আন্তর্জাতিক মহলের চাপ উপেক্ষা করে পাতানো নির্বাচনের পথে হাঁটতে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের উজ্জীবিত করছেন। এ ছাড়াও বাম নেতা হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, দিলীপ বড়–য়া, ফজলে হোসেন বাদশার মতো নেতারা যারা গত কয়েক বছর এমপি, মন্ত্রী হয়ে ভাগ্যের পরিবর্তন করেছেন; তারাও আওয়ামী লীগে নীতিনির্ধারকদের উস্কে দিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমনকি জাতিসংঘের চাপ উপেক্ষা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন করতে। কারণ ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন হয়েছে বলে তারা এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে তাদের কেউ জামানত রক্ষা করতে পারবেন না।

নির্বাচন প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, হুমকি-ধমকির মধ্য দিয়ে রাজনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। এবারও নির্বাচন হবে। ১৪ দলীয় জোট নির্বাচনে অংশ নেবে। জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে। প্রশ্ন হলো যারা আন্দোলন করছে তারা সরকার উৎখাত করতে পারবে কি না। যদি তারা আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার উৎখাত করতে না পারে তাহলে নির্বাচন হবে। এটা ঠিক নির্বাচন বর্জন, সরকার উৎখাতের রাজনীতির চক্রান্তের সংস্কৃতি শুরু হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীরা বিএনপির সঙ্গী হয়েছে। বিএনপি যে সরকার উৎখাতের চক্রান্ত করছে তা মোকাবিলা করতে হবে। চলমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন নিয়ে সংকট মনে হচ্ছে। তবে এটা থাকবে না। নির্বাচনে কে এলো আর কে এলো না সেটা মুখ্য বিষয় নয়; নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে ভোট নিরপেক্ষ হলো কি না, ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারলেন কি না।

অন্যদিকে ২০১৮ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে আয়োজিত নির্বাচনের ফাঁদে পা দিয়ে প্রতারিত হয়ে বিএনপি এবার শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছে। তারা পাতানো নির্বাচনের আয়োজন করার চেষ্টা করলে এবার ২০১৪ সালের মতোই নির্বাচন প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিএনপির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, তারা এখন ধারাবাহিক কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হলেও তফসিল অক্টোবরে অলআউট কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নামবেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। এর ব্যত্যয় হবে না। পাতানো নির্বাচন করার চেষ্টা করলে তা জনগণকে নিয়ে প্রতিহত করা হবে।’ দলটির স্থানীয় কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত না করে আমার লাশ চিতায় উঠবে না।’

মূলত দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির নেতারা এবার মরণপণ নিয়ে মাঠে নেমেছেন। লাখ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শত শত মামলা মাথায় নিয়ে, জেল-জুলুম সহ্য করে দলটির নেতাকর্মীরা মাঠে রয়েছেন। গত কয়েক বছর দলটির নেতাদের মাঠে নামতে দেয়া হয়নি। অতঃপর ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র‌্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর বিএনপিকে মাঠে নামতে দেয়া হয়। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে দলটির তৃণমূল পর্যায়ে সভা করে নেতাকর্মীদের সুসংগঠিত করার উদ্যোগ নেয়। অতঃপর ওই বছরের অক্টোবর মাসে বিভাগীয় পর্যায়ে সম্মেলন করে। ওই সব সম্মেলনে নানা বাধা- বিপত্তির মুখেও লাখ লাখ নেতাকর্মী সমাবেশে জড়ো হন। এমনকি সমাবেশের দু-তিন দিন আগে শত মাইল পায়ে হেঁটে, রিকশা-ভ্যানে করে সমাবেশস্থলে হাজির হন। ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে। দলটির শত শত নেতাকর্মীকে কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়, যা দেশি ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোয় খবরের শিরোনাম হয়। ওই বছরের ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে ১০ লাখ লোকের সমাবেশ করে। ওই সমাবেশে দলটির সংসদ সদস্যরা পদত্যাগের ঘোষণা দেন। চলতি বছরে বিএনপি একের পর এক সমাবেশ ও পথযাত্রা কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং লাখ লাখ লোকের সমাবেশ ঘটায়। এর মধ্যে প্রথমে ২৭ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। এখন এক দফার কর্মসূচি পালন করছে দলটি। এক দফা হচ্ছে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। দলটি এরই মধ্যে সরকারের সুবিধাভোগী দলগুলো ছাড়া দেশের বেশির ভাগ দলকে যুগপৎ কর্মসূচিতে নিয়ে এসেছে। ইসলামী ধারার দল এবং সিপিবিসহ যেসব বাম দল যুগপৎ কর্মসূচিতে নেই তারাও একই দাবিতে আন্দোলন করছে। দলটির একাধিক নেতা জানান, এরই মধ্যে দলের অনেক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে; মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ প্রায় শতাধিক নেতার মামলা কার্যক্রম হঠাৎ করে চালু করেছে। এত জুলুম-নির্যাতনের পরও ধারাবাহিক কর্মসূচি নিয়ে দলটি মাঠে থাকবে। দলের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখবে। এর মধ্যে সরকার যদি আন্তর্জাতিক মহলকে উপেক্ষা করে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করে তাহলে অলআউট কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে। দলটির নেতারা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের অবস্থানে নেই। যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। এমনকি ভারত আগের মতো আওয়ামী লীগকে সমর্থন না করার বার্তা দিয়েছে। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেয়া নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, আওয়ামী লীগকে মানুষ এখন ঘৃণা করে। সর্বস্তরের মানুষ সেই দলের পদত্যাগ চায়। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে আমাদের কাছে পরাজিত। বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে এখন আন্তর্জাতিক মহলও জোর দিয়েছে। আগামী চার মাসের মধ্যে সরকারের পতন, চার মাসের মধ্যেই নির্বাচন। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু গতকাল বলেন, আওয়ামী লীগ বাকশাল ছাড়া কিছুই বোঝে না। ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার থাকবে। জানুয়ারির মধ্যে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।

Related Posts