ভাই গিরিশচন্দ্র সেন – বাংলা ভাষায় কোরান এর সর্বপ্রথম অনুবাদক
মুসলমান সম্পদ্রায়ের পবিত্র গ্রন্থ কোরান-শরীফের সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদক এবং নবীজীর প্রথম বাঙালী জীবনীকার মৌলভী ভাই গিরিশচন্দ্র সেন। সাবেক বিক্রমপুর বর্তমান নরসিংদী জেলার পাঁচদোনা গ্রামে এক বিখ্যাত দেওয়ান বৈদ্যবংশে ১৮৩৪ খ্রীস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের পিতৃদেব মাধবরাম সেন এবং পিতামহ রামমোহন সেন। মাধবরাম সেনের তিনপুত্র যথাক্রমে ঈশ্বরচন্দ্র সেন, হরচন্দ্র সেন এবং সর্বকনিষ্ঠ গিরিশচন্দ্র সেন।
ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের পরিবার ছিল সনাতনধর্মাবলম্বী। পরিবারে সনাতন ধর্মের অনুশীলন কড়াকড়িভাবে মেনে চলা হতো। এমন একটি পরিবারে জন্ম নিয়েও ভাই গিরিশচন্দ্র সেন সম্পূর্ণ সংস্কার মুক্ত মানুষ হিসেবে বিকশিত হতে পেরেছিলেন সনাতন হিন্দুধর্মের প্রতিবাদী শাখা ব্রাহ্মধর্মের কল্যাণে। ১৮২৯ খ্রীস্টাব্দে রাজা রামমোহন রায় কর্তৃক প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্ম হলো বাংলা তথা ভারতবর্ষের যুগোপযুগী একেশ্বরবাদী, নিরাকারপন্থী, নারী-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, জাত-পাত-বর্ণবৈষম্যের ঊর্ধ্বে স্থাপিত আধুনিক ধারণা।
মূলত গুরুভাই কেশবচন্দ্র সেনের ঐকান্তিক অনুরোধেই স্বদেশীয়দের মাতৃভাষায় ধর্মচর্চার পথ উন্মুক্তকরণে গিরিশচন্দ্র সেন কোরান-শরীফ অনুবাদে আত্মনিয়োগ করেন। ১৮৮৪ খ্রীস্টাব্দে কোরান-শরীফ সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়।
প্রাচীনকালে মানুষ যেমন নবোদিত সূর্যদেবকে সশ্রদ্ধ প্রণতি জানিয়ে প্রতি প্রত্যুষে প্রার্থনা করতেন এই বলে যে, “হে সূর্যদেব, আমাকে তোমার অনন্ত আলোকের বৈভব দাও- তোমার আলোকের মতই আমাকে জ্ঞান, গুণ ও মানবতার আলোকে বিভূষিত করো।” ঠিক তেমনি ভাই গিরিশচন্দ্র সেন নিজে তো বটেই, উপরন্তু প্রিয় মাতৃভূমির জনসাধারণের জন্যও এমনি প্রার্থনাকে ধ্যান-জ্ঞান করে জীবনে অবশ্যপালনীয় ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। আর সেজন্যই তিনি আরবী, পার্সি, হিন্দী ভাষা রপ্ত করে ইসলামী শাস্ত্র চর্চায় হয়েছিলেন সুপণ্ডিত।
১১৯৯-এ বিহার এবং ১২০৩-এ বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক বঙ্গ দখলের পর থেকে ১৭৫৭তে সিরাজুদ্দৌলার পতনের আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ৫৫৪ বছরের মুসলিম শাসনামলে ‘পবিত্র’ ধর্মগ্রন্থ কোরান বঙ্গানুবাদের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়! ১৮১০-এ আমীরউদ্দীন বসুনিয়া নামক রংপুরের এক অধিবাসী গোপনে গ্রন্থটির ৩০তম পারা তথা আমপারার বঙ্গানুবাদ করেন। এরপর ১৮৬৮তে শায়ের গোলাম আলী এবং মীর ওয়াহেদ আলী নামক দু’ব্যক্তি ঐ একই আমপারার বঙ্গানুবাদ গোপনে প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য যে, আমপরাটি হচ্ছে কোরানের ৩০তম পারা, যা পৃথকভাবে সংকলিত পুস্তিকা হিসেবে ‘আমপারা’ (সাধারণ্যে আমছেপারা) নামে পঠিত হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, মাতৃভাষা বাংলায় কোরান অনুবাদ ও প্রকাশ গোপনে কেন?
১৮৭৯-এর ১৯ মার্চ, গ্রন্থটি রাজেন্দ্রনাথ মিত্র কর্তৃক আংশিক প্রথম খণ্ডাকারে অনূদিত হয়ে স্বয়ং অনুবাদক কর্তৃক প্রকাশিত এবং মুদ্রাকর মিহিরচন্দ্র রায়ের আয়ুর্বেদ প্রেস, কলকাতা থেকে মুদ্রিত হয়। এরপর ১৮৮৪তে ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ভাই কেশবচন্দ্র সেনের অনুরোধে তদীয় শিষ্য ভাই গিরিশচন্দ্র সেন ৫ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে গ্রন্থটির সম্পূর্ণ বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করেন। এই মহতী কর্মসাধনে ব্যাপৃত থাকাকালে তাঁকে ৪২ বছর বয়সে আরবী, হিন্দী, ফার্সি এবং উর্দু ভাষা শিক্ষার জন্য লক্ষ্ণৌ গমন করতে হয়। লক্ষ্ণৌ নগরীতে তিনি সুবিজ্ঞ ও প্রবীণ আলেম মাওলানা ইহসান আলীর নিকট তালিম নেন। প্রশ্ন হচ্ছে, আরবী, হিন্দী, ফার্সি এবং উর্দু ভাষায় অসংখ্য তালেবর মুসলিম পণ্ডিত থাকা সত্ত্বেও একজন ব্রাহ্ম মতাবলম্বীকে কেন এই কাজে হাত দিতে হলো?
ইসলাম ধর্মশাস্ত্রে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য তৎকালে তাঁকে “মাওলানা” টাইটেল প্রদান করা হয় এবং তিনি নামের অগ্রে তা ব্যবহার করে লিখতেন, “মাওলানা ভাই গিরিশচন্দ্র সেন।” মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থের বঙ্গানুবাদে কেন তিনি ব্যাপৃত হয়েছিলেন, এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “পৃথিবীর যাবতীয় সভ্য ভাষায় বাইবেল পুস্তক অনুবাদিত হইয়া সর্বত্র সকল জাতির মধ্যে প্রচার হওয়ায় সাধারণের পক্ষে তাহা সুলভ হইয়াছে। …কিন্তু পরাক্রান্ত মোসলমান তাহাদের মূল বিধান পুস্তক কোরান শরীফ শুধু তাহাদের মধ্যেই দুরূহ আরব্য ভাষারূপ দুর্ভেদ্য দুর্গের ভিতর আবদ্ধ রাখিয়াছে। অন্য জাতির নিকট মোসলমানেরা কোরান বিক্রয় পর্যন্ত করেন না, অপর লোকে তাহা পড়িবে দূরে থাকুক, স্পর্শ করিতে পায় না। অন্য জাতির মধ্যে আরব্য ভাষার চর্চাও বিরল। কেহ কোরান হস্তগত করিতে পারি্লেও ভাষা জ্ঞানের অভাবে তাহার মর্ম অনুধাবন করিতে সক্ষম হয় না।” এবংবিধ উপলব্ধি থেকে প্রিয় স্বদেশবাসীর যারা নবধর্ম ইসলাম গ্রহণ করেছেন তাদের জন্যই তিনি গ্রন্থটির বঙ্গানুবাদে সচেষ্ট হোন।
অথচ একজন হিন্দু পরবর্তীতে ব্রাহ্ম তথা কাফের কর্তৃক ‘পবিত্র’ ধর্মগ্রন্থ কোরান অনুবাদের পুরস্কার স্বরূপ তৎকালে মুসলমানরা তাঁর ‘পরে যার পর নাই ক্ষিপ্ত হয়ে বাড়িতে কাফনের কাপড় সহ একটি পত্র প্রেরণ করে এই মর্মে হত্যার হুমকি দিয়েছিল যে, “মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হ।” দুর্ভাগ্য আরো এই যে, স্বাধীন বাংলাদেশের বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণকারী এই কর্মদ্যোগী মহান মানুষটির মহতী কর্মের প্রতি কো্থাও কোনো শ্রদ্ধা বা কৃতজ্ঞতার বিন্দুমাত্র উদ্যোগ দৃষ্টিগোচর হয় না। এমনকি সাবলীল বাংলায় তাঁর অনূদিত কোরানের সংস্করণটির চর্চাও হয় না কোথাও!!! হায় অকৃতজ্ঞ ও দুর্ভাগা দেশ…
মৌলভী ভাই গিরিশচন্দ্র সেন কর্তৃক সম্পাদিত অমূল্য কৃতকর্মের জন্য মুসলমান সম্পদ্রায়ের মধ্য থেকে নানাবিধ ভর্ৎসনা জুটলেও একমাত্র মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়া তাঁকে আপন পুত্র জ্ঞান করে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। প্রিয় মাতৃভূমির ক্ষণজন্মা মনীষী মৌলভী ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের অমর স্মৃতির প্রতি নিবেদন করছি শ্রদ্ধাঞ্জলি…