এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সেই দুর্গে ফাটল ধরেছে। এবার ‘নৌকা’ প্রতীককে কঠিন চ্যালেঞ্জে ফেলেছে ‘ঈগল’ প্রতীক। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন (ঈগল প্রতীক)। এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী টানা দুবারের সংসদ সদস্য, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী।
হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর ও চুনারুঘাট উপজেলা নিয়ে গঠিত হবিগঞ্জ-৪ আসনটিতে ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ৭টি নির্বাচনে ৬ বার জিতেছে আওয়ামী লীগ। শুধুমাত্র ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে (পরবর্তীতে একই বছরের জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়) বিএনপির প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন। চা-বাগান অধ্যুষিত এ আসনটি আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত।
ব্যারিস্টার সুমন এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। শুধু দলের নেতাকর্মীই নন আওয়ামী লীগের শক্ত দুর্গ চা-শ্রমিক ভোটাররাও বিভক্ত। তাই এ আসনে জয়-পরাজয়ের নির্ণায়ক হবে চা-শ্রমিকদের ভোট। ফলে নৌকা ও ঈগলের প্রার্থী প্রচারণার বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছেন চা-বাগান অধ্যুষিত এলাকায়। চেয়েছেন নিজের মার্কায় ভোট। আর জয়ী হতে দিচ্ছেন, কত শত প্রতিশ্রুতি। স্থানীয়দের সাথে আলাপকালে এমন তথ্য পাওয়া যায়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণার শেষ দিকে গত মঙ্গলবার চুনারুঘাট বাজারে জনসভা করেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। একই জায়গায় বুধবার স্বতন্ত্র প্রার্থী যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনও জনসভা করেন। দুজনের জনসভায় প্রচুর লোক সমাগম হয়েছে।
পৃথক সভায় ভোটারদের মন জয় করতে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তারা। তবে ভোটাররাও কষছেন হিসেব নিকেশ, কেমন প্রার্থীকে ভোট দেবেন তারা।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জনসভা চলাকালে কথা হয় চুনারুঘাট উপজেলার দেওরগাছ ইউনিয়নের বাসিন্দা ব্যবসায়ী ষাটোর্দ্ধ তারা মিয়ার সাথে। তারা মিয়া জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে আসা কেন্দ্রীয় যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশকে দেখতে আসেন। তিনি জানান, যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনিকে খুব ভালোবাসতাম। তার ছেলে আসছে শুনে তাকে দেখতে আসছি।
তারা মিয়া বলেন, ‘‘দাদা এখানে ভোটের হিসাব বোঝা দায়। ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে ভোটের সমীকরণ। প্রচারণার শুরুর দিকে একচেটিয়া ঈগলের অবস্থান ছিল। শেষ দিকে এসে নৌকা কিছুটা এগোলেও ঈগল থেকে পিছিয়ে আছে। তবে যদি চা বাগানের ভোট নৌকা একচেটিয়া পায় নৌকা পাশ করবে। নতুবা বিপদ আছে।’’
তার সাথে কথা বলার সময় দেখা হয় দেওরগাছ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের এক জ্যেষ্ঠ নেতার সাথে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি খোলামেলা কথা বলেন।
আক্ষেপের সুরে ওই নেতা বলেন, ‘‘দলের অনেক দুর্বলতা আছে। মন্ত্রী সাহেব খুবই ভালো মানুষ। অত্যন্ত সৎ-স্বজ্জন মানুষ। কিন্তু তার কাছের কিছু মানুষের জন্য নৌকা হারে হারে অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি নিজেই অবহেলিত হয়েছি। কিন্তু হৃদয়ে নৌকা। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দায়িত্বে আছি। মনে প্রাণে কাজ করছি। কিন্তু ফল কি হবে জানি না।’’
ওই নেতার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাইকপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আরেক নেতা বলেন, ‘‘আমার ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর অনুষ্ঠান হয়েছে। আমাকে জানানো হয়নি। কিন্তু আমি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছি। খবর শুনে গিয়েছিলাম। কাজও করছি নৌকার জন্য। তবে নৌকা হারলে হারবে খন্দকার মুশতাকদের জন্য।’’
খন্দকার মুশতাক বলতে ওই নেতা বুঝিয়েছেন, ‘‘অনেকে নৌকার সাথে প্রকাশ্যে আছেন। কিন্তু গোপনে স্বতন্ত্রের সাথে কাজ করছেন। তাদের কারণে চা বাগানের ভোটেও ঈগল ঝাপটা দিয়েছে।’’
এ উপজেলার দুর্গাপুর বাজারে কথা হয় খেলু মিয়ার সাথে। তিনি আহম্মদাবাদ ইউনিয়নের বাসিন্দা। খেলু মিয়া বলেন, ‘‘শেষ মুহুর্তে লড়াইটা হাড্ডাহাড্ডি হবে। মানুষের মাঝে ভোটের আমেজ আছে। আবার আতঙ্কও আছে। ভোটের দিন মারামারি হতে পারে এমন আশঙ্কার কথা জানান তিনি।’’
আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মী ও চা শ্রমিক ভোটারদের বিভক্তির বিষয়টি বুঝা যায় বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল এবং তরুণ চা শ্রমিক নেতা দিপক রাজ প্রধান, মাধবপুর উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক আতাউস ছামাদ বাবু ও মাধবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিনের বক্তব্যে।
চা শ্রমিকদের তরুণ প্রতিনিধি দিপক রাজ প্রধান স্বতন্ত্র প্রার্থী সুমনের পক্ষে জোরালোভাবে মাঠে কাজ করছেন। অন্যজন চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল নৌকার পক্ষে কাজ করছেন।
চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, ‘‘চা শ্রমিকদের ১৯দিনের আন্দোলনের সময় মন্ত্রী মাহবুব আলী সারাসরি আমাদের সাথে ছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সাথে কথা বলাই দিছে। দুই তিনটা বিষয়ে উনি কাজ করেছে। আমাদের চোখের সামনে। আমাদের নিয়েই করেছেন। এজন্য উনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। চা বাগানের ভোট মাহবুব আলীই পাবেন।’’
অন্যদিকে তরুণ চা শ্রমিক নেতা দিপক রাজ প্রধান বলেন, ‘‘ব্যারিস্টার সুমন ভাইকে সবাই মন থেকে ভালোবাসে। কারণ তাকে আমরা বিপদে আপদে পাই। আমাদের আন্দোলনের সময় তাকে পাশে পেয়েছি। তার দেওয়া খাবার অনেক শ্রমিক পেয়েছে। এজন্য সুমন ভাইকে ভালোবেসে তার জন্য খাটতাছি (কাজ করতেছি)। সুমন ভাইকে ভোট দেব।’’
আলাপকালে মাধবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন বলেন, ‘‘প্রতিমন্ত্রীর কাছে গেলে তিনি তার ব্যক্তিগত সহকারীর সঙ্গে কথা বলতে বলেন। কোনো সহযোগিতা পাইনি। তিনি আবার এমপি হলে মানুষ অবহেলার শিকার হবে। তাই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী সায়েদুল হকের জন্য কাজ করছি।’’
বৃহস্পতিবার রাতে মুঠোফোনে আলাপকালে মাধবপুর উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক আতাউস ছামাদ বাবু বলেন, ‘‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমরা ১ লাখ ভোটের ব্যবধানে জিতব। দলের বেশিরভাগ নেতা আমাদের প্রার্থী সুমন ভাইয়ের পক্ষে। মাধবপুরের উপজেলা আওয়ামী লীগের অন্তত ৬ থেকে ৭ জন সহ সভাপতি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, ১১টি ইউনিয়নের মধ্যে ৭টি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি আমাদের সাথে আছেন।’’
তবে যারা নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে তারা বেইমানি করছেন জানিয়ে মাধবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান আতিক বলেন, ‘‘মাঠের অবস্থা খুবই ভালোই। বিপুল ভোটে আমরা পাশ করব।’’
বুধবার মাধবপুর উপজেলা প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে বসে কথা হয় সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ সভাপতি শেখ আরিয়ান রুবেলের সাথে। তিনি হবিগঞ্জ-৪ আসনে নির্বাচনে ছাত্রলীগের সমন্বয় টিমের সদস্য। তার বাড়ি মাধবপুর উপজেলায়।
শেখ আরিয়ান রুবেল বলেন, ‘‘আমাদের মন্ত্রী একজন সৎ, স্বজ্জন মানুষ। অনেকে তার বিরোধীতা করছেন। আমরা মাঠে কাজ করছি। তবে শেষ পর্যন্ত নৌকার জয় হবে। এটা আমার বিশ্বাস।’’
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, চা-বাগান আর আওয়ামী লীগের ভোটে বিভক্তির কারণে ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে ভোটের সমীকরণ। তবে এখানে শেষ মূহুর্তে ভোটের সমীকরণ কিছুটা পাল্টাতে পারে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, এই আসনে বাড়ি দেশের শীর্ষ স্থানীয় এক শিল্প পরিবারের কর্ণধারের। দুই উপজেলার ভোটে এ পরিবারের বড় প্রভাব রয়েছে। তারা যাকে সমর্থন করবেন, তার কপালে পড়বে রাজটীকা!
আর মাত্র ১টি রাত পেরোলেই ভোটের রবির দেখা। দিনটি ৭ জানুয়ারি, রবিবার। এদিন সারাদেশের চোখ থাকবে হবিগঞ্জ-৪ আসনে। আওয়ামী লীগের দুর্গে ঈগলের ‘ঝাপটা’ নাকি নৌকার ধারাবাহিকতা, হিসেব মিলবে ভোটে।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, এ আসনে মাহবুব আলী ও সায়েদুল হক সুমনসহ আটজন প্রার্থী আছেন। অপর ছয় প্রার্থী হলেন আবু ছালেহ (ইসলামী ঐক্যজোট), আহাদ উদ্দিন চৌধুরী (জাতীয় পার্টি), মোহাম্মদ আবদুল মমিন (বাংলাদেশ কংগ্রেস), মো. মোখলেছুর রহমান (বিএনএম), মো. রাশেদুল ইসলাম খোকন (বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট), সৈয়দ মো. আল আমিন (বাংলাদেশ কংগ্রেস)। শিল্প-কারখানা ও চা বাগান অধ্যুষিত এ আসনে মোট ভোটার ৫ লাখ ১২ হাজার ৩০৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৪। নারী ২ লাখ ৫৪ হাজার ৪২৩ জন। তৃতীয় লিঙের ভোট রয়েছে একটি।