গণহত্যার স্বীকৃতি দিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন দেশি–বিদেশি গবেষকরা। তারা বলেছেন, বাংলাদেশের গণহত্যা বৈশ্বিক ইতিহাসের অংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর কোনো দেশে মাত্র ৯ মাসে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যার ঘটনা ঘটেনি। নির্বিচারে দেশের আনাচে-কানাচে নির্মমভাবে হত্যা–ধষর্ণসহ নৃশংসতা চালিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। নানা জরিপ ও গবেষণায় এসব হত্যাযজ্ঞের প্রমাণ উঠে এসেছে। এরপরও কেউ কেউ প্রশ্ন করে, মুক্তিযুদ্ধে কি আসলেই ৩০ লাখ শহীদ হয়েছেন? যারা এসব প্রশ্ন তোলে তারা বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে যেতে চায়। এই অপশক্তির বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
শনিবার রাজধানীর বাংলা একাডেমী মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশ গণহত্যা স্মরণ ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ বহুমাত্রিকতার খোঁজে’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আলোচকরা এসব কথা বলেন। সম্মেলন উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রকল্প ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট এই সম্মেলন আয়োজন করে।
ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ড. সজল নাগ। উদ্বোধনী পর্বে আরও বক্তব্য দেন জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি বিশিষ্ট কবি তারিক সুজাত ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ট্রাস্টি সম্পাদক ড. চৌধুরী শহীদ কাদের।
প্রধান অতিথির বক্তৃতায় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে সব বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতাকে হার মানিয়েছিল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার জন্য এত রক্ত পৃথিবীতে এর আগে কেউ দেয়নি। কেউ কেউ মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক করেন, প্রশ্ন তোলেন। আমি মনে করি, শহীদের সংখ্যা নিয়ে এ সংখ্যাতাত্ত্বিক বিতর্ক তাদের প্রতি অবমাননার শামিল। গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র কর্তৃক পরিচালিত জরিপে ইতোমধ্যে চিহ্নিত বধ্যভূমির সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। এ জরিপ সম্পন্ন হলে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ৩০ লক্ষ ছাড়াবে।’
মূলপ্রবন্ধে অধ্যাপক ড. সজল নাগ বলেন, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনই জাতিগঠনের পথ দেখালেও এই প্রক্রিয়ার আরেকটি দিক স্পষ্ট করে তুলেছিল আধিপত্যশীল জাতীয়তা ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী। আধিপত্যশীল জাতীয়তা প্রায়শই নতুন জাতিরাষ্ট্রে আধিপত্য বিস্তার করে ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা ও গোষ্ঠীকে দমন করে, যারা জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষা লালন করত। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম আধিপত্যশীল জাতীয়তার অভ্যন্তরীন উপনিবেশবাদ, নিপীড়ন ও আধিপত্যবাদের ভেঙে বেরিয়ে আসার উদাহরণ হয়েছিল। পাকিস্তানি রাষ্ট্রের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় নিপীড়ক রাষ্ট্রের সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের বিজয়ের প্রতীক। ধূমকেতুর ন্যায় বাংলাদেশের উত্থান জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদী বয়ানকে কাপিয়ে দিয়েছিল।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘আমাদের দেশ স্বাধীন করতে গিয়ে এত হত্যা, ধর্ষণ, এত মৃত্যু হয়েছে। এরপরেও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি গণতন্ত্রের নামে এখানে রাজনীতি করতে পারে। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি বিরল। বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী এবং ধর্মান্ধ সমস্ত দলগুলো হলো স্বাধীনতাবিরোধী। এরা জাতির পিতা কেন, বাংলাদেশের জয়কেও অস্বীকার করে। আমাদের একথা বলার সাহসিকতা রাখা উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা তাদের আইনে আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধে খুনি ও ঘাতকদের আশ্রয় দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে আইনে তো সেটা নেই। এখন সময় এসেছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে আমরা কি এমন নেতৃত্ব চাই যেটা পুনরায় পাকিস্তানের সামন্ত শাসন ফিরিয়ে আনবে? সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আসবে আগামী জানুয়ারিতে।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সম্মেলনের তিনটি কর্ম অধিবেশন পরিচালনা করা হয়। ভারত ও বাংলাদেশের ২০ গবেষক মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা ও বাংলাদেশের নানা দিক দিয়ে অধিবেশনগুলোতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। পৃথক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করবেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, শিল্পী হাশেম খান, অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।
শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘পচাত্তরের পর থেকে বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় পরিচালনা করার জন্য নানা তৎপরতা চলছে। আমরা এর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বর্তমান সরকারও চেষ্টা করছে। তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা বিষয়ে গবেষণা কাজে উদ্ধুদ্ধ করতে হবে। তারা যত গবেষণা করবে ততই দালিলিক তথ্যপ্রমাণের আলোকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সমৃদ্ধ হবে ‘
পৃথক অধিবেশনে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রবন্ধকার সঞ্জয় কে ভরদ্বাজ, তিস্তা দাস, কিংশুক চ্যাটার্জি, সাগর তরঙ্গ মণ্ডল, চৌধুরী শহীদ কাদের, সহুল আহমদ, অনিন্দিতা বন্দ্যোপধ্যায়, পুনম মুখার্জি, মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, সুশ্রিতা আচার্যী, কৌশিক বন্দ্যোপধ্যায়, অনিন্দিতা ঘোষাল প্রমুখ। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সভাপতিত্বে সমাপনী অধিবেশনে বক্তব্য দেন সংস্কৃতিবিষয়ক সচিব খলিল আহমদ, লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক, ভারতের গবেষক অনিন্দিতা ঘোষাল, কিংশুক চাটার্জী ও বাংলাদেশের মুর্শিদা বিনতে রহমান।
এর আগে সকালে জাতীয় সঙ্গীত দিয়ে সম্মেলন শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন পর্যায়ে গণহত্যা জাদুঘরের নতুন ওয়েবসাইট উদ্বোধন, নতুন দুটি প্রকাশনীর মোড়ক উন্মোচন এবং স্মারক হস্তান্তর করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যাভিত্তিক স্মারক হস্তান্তর করেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতা কাওসার চৌধুরী ও ভারতের পুনম মুখার্জী। এছাড়াও অনুষ্ঠান শেষে ভারতীয় বিখ্যাত পরিচালক কৃষ্ণেন্দু বোসের পরিচালনায় নির্মিত ‘বে অফ ব্লাড’ প্রদর্শিত হয়।