কে ছিলেন তিতুমীর !

তিতুমীরের আসল সত্য :

ছোটোবেলায় খুব সম্ভবত ক্লাস ৪ কি ৫ এ একটা গল্প পড়তে হত বাঁশের কেল্লা নামে! স্বাভাবিক। তখন বামফ্রন্টের আমল! বাম না বলে বামাতি বলাই ভালো। প্রত্যেক শাসকগোষ্ঠীই চায় শিশুদের মস্তিষ্কে তাদের আইডিওলোজি ঢুকিয়ে দিতে। ওরাও তার ব্যতিক্রম ছিলো না। যে কারণে তিতুমীর কে রীতিমতো স্বাধীনতা সংগ্রামী বানিয়ে হিরো ওয়ারশিপের ব্যবস্থা করা হয়েছিল আরকি!

তো সেইসময় গল্পটা পড়তে গিয়ে একটা খচখচানি হত। এত বড় বীর ‚ এত বড় যোদ্ধা ! কিন্তু ছাগলের মতো বাঁশের কেল্লা বানিয়ে কামানের বিরুদ্ধে লড়তে গেলো কেন? যদিও বড় হয়ে এর উত্তর ভালোভাবে পেয়ে গেছিলাম- মক্কা থেকে ফেরার পর তীতুমীরের ফাজলামি দেখে আম পাবলিক ওকে যে পরিমাণ বাঁশ দিয়েছিল তাতে সেগুলো দিয়ে আস্ত একটা বাঁশের কেল্লা খাড়া করে দেবে এতে আর আশ্চর্যের কি আছে?

যাকগে আসল কথায় আসি। তিতুমীর সম্পর্কে একটা লেখা পড়লাম ১৮৭০ সালে প্রকাশিত “The Calcutta review, Volume 51” গ্রন্থের “The Wahhabis In India” তে। সেখানে তিতুমীর সম্পর্কে যা যা বলা আছে একটু শর্টে পয়েন্ট করে দিই বরং! যদি আপনাদের জানা কিছু মিথ ভাঙ্গে এটা পড়ে।

১- তিতুমীর প্রথম জীবনে কিছুদিন জমিদারের লাঠিয়ালের কাজ করত। সেখানে জমিদারের হয়ে বড়সর গোলমাল পাকিয়ে কিছুদিন জেলও খেটেছিল ! খুব সম্ভবত তীতুমীরের ভ্যানগার্ড ইমেজটা রক্ষার জন্য এই অংশটা সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়।

২ – তিতুমীর কখনোই গরীব কৃষক সন্তান ছিলোনা! তাদের ছিলো বনেদী বংশ! বিবাহসূত্রে মুনশী আমির নামে এক ধনকুবেরের সাথে তার আত্মীয়তা হয়। অর্থাৎ দরিদ্র সে কখনোই ছিলো না। এই টাও নিশ্চয়ই আপনারা জানেন না? কারণ পূর্বোল্লিখিত।

৩ – তিতুমীর কোনো কৃষক বিদ্রোহ ঘটায়নি। সে ঘটিয়েছিলো ধর্মীয় আন্দোলন । সে তার অনুগামীদের দাড়ি রাখতে ‚ স্থানীয় কাফের দের সাথে না মিশতে নির্দেশ দিতো।

৪ – তাই বলে তিতুমীর কে আবার মুসলিম দের মুখ বলে ভাবলেও ভুল হবে। তীতুমীরের বাড়াবাড়িতে স্থানীয় দরিদ্র মুসলিম কৃষক ‚ যারা হানাফি নামে পরিচিত ছিলো ‚তারা জমিদারের কাছে নালিশ করে।
তারপরই জমিদার তীতুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।
অর্থাৎ সেই তথাকথিত কৃষক বিদ্রোহের ঘ্যানঘ্যানি ন্যারেটিভও জাস্ট বোগাস।

৫ – যেহেতু তিতুমীর অনুগামীদের দাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক ছিলো ‚ সেইজন্য জমিদার কিষেন রায় (খুব সম্ভবত কৃষ্ণ রায় ‚ ইংলিশ উচ্চারণে বিকৃত হয়ে গেছে ) প্রজাদের দাড়ির উপর উচ্চহারে ট্যাক্স বসায়। যাতে টাকা দেওয়ার ভয়ে কেউ তীতুমীরের দলে ভীড় না করে।

অর্থাৎ গড়ে যে বলা হয় জমিদার মুসলিম দের দাড়ির উপর ট্যাক্স বসিয়েছিলো ‚ মানে সেই মুসলিম দের উপর হিন্দু দের সাম্প্রদায়িক অত্যাচারের যে ছবি সর্বত্র দেখানো হয় সেটাও একটা মিথ্যে প্রোপাগান্ডা মাত্র।

৬ – এখানে একটা টুইস্ট। সরফরাজপুর বলে এক অঞ্চলে কিষেন রায়ের লোক ট্যাক্স আদায় করতে গেলে ব্যাপক দাঙ্গা হাঙ্গামা বাঁধে তিতুমীর এর অনুগামী দের সাথে। একটি মসজিদ ভাংচুরও করা হয়। যাকে পুঁজি করে তীতুমীরের দলবল গ্রামে গ্রামে ইসলাম বিপন্ন টাইপ হাউকাউ করে বেড়াতে শুরু করে।

যদিও পরে কোর্ট রায় বেরোয় যে তীতুমীরের দলবলই গ্রাম জ্বালিয়ে ‚ মসজিদ ভেঙ্গে পাবলিক খেপানোর তাল করেছিলো।

৭- যে দারোগা এই ঘটনার তদন্তের দায়িত্বে ছিলো মাসকয়েক পর সে ওয়াহাবী দের হাতে ধরা খায়!
তীতুমীরের অনুগামীরা তাকে ধরে খুচিয়ে মারে তদন্তের ফল তার পক্ষে না দেওয়ার অপরাধে।

৮- ৬ই নভেম্বরের দিকে শপাঁচেক তীতু-অনুগামী লাঠিসোটা নিয়ে পূর্ণিয়া গ্রামে আক্রমনে চালায়। একটি ব্রাহ্মনকে পিটিয়ে মারা হয় , দুইটি গরু ছিনিয়ে নিয়ে হিন্দুদের মন্দিরে জবাই করে গরুর রক্তে মন্দির ভাসিয়ে দেয়া হল। দেবতার মূর্তির গায়ে গরুর মাংস ঝুলিয়ে রাখা হয় । দোকানপাটে পাইকারি লুটপাট চলে , স্মিথ নামে একটি নিরীহ খ্রিস্টানকে অকারনে থাবড়ানো হয় আর হানাফি মুসলমানদের অপমান করা হয়!

..#এখানে শেষ পয়েন্ট টা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! বিশেষত বাংলাদেশী জামাতি বা পশ্চিমবঙ্গে তাদের শাখাগুলো তীতুমীরকে মুসলিম দের মসীহা বলে দেখাতে চায় ! কিন্তু মজা হল তিতুমীর নিজের আর মিশকিন শাহ বলে এক ফকিরের অনুগামী যোগ করে মোটামুটি হাজার জন মত লোক ছিলো তার পক্ষে। বাকি সব মুসলিম গ্রামবাসীই কিন্তু ছিলো তার বিপক্ষে!

৯- পরের দিন ভোরে তারা নদেয়ার লাউঘাট গ্রামে ঢোকে। সেখানেও তারা আগেরদিনের মতো মন্দির গরুর রক্তে ভাসিয়ে দেবার ধান্দা করার সময় স্থানীয় হিন্দুর দল বাধা দেয়। শুরু হয় রায়ট। গ্রামের মাতব্বর তার ভাইসহ খুন হয়, নিহত হয় আরো অনেক গ্রামবাসী।
.
১০- এরপরে তারা নারকেলবেড়িয়ার কেল্লায় ফিরে যায়। পরের কয়দিন কাটে রামচাঁদপুর আর হুগলীর গ্রামে তান্ডব করে, হিন্দুদের জোর করে ধর্মান্তরিত করে।

১১- ১৪ তারিখে তারা শেরপুরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলমান ব্যক্তি ‚ যে কিনা তীতুমীরের বিরোধী ছিলো ‚ তার ঘর লুট করে, আর তার কন্যাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।
অর্থাৎ এখানেও সেই একই কথা।শুধু হিন্দুরা না ভদ্র মুসলিমরাও তীতুমীরের শিকার হয়েছিল!

১২ – একবার তারা হামলা করে হুগলী কুঠি। ম্যানেজার আর তার পরিবারকে বাঁশের কেল্লায় নেওয়া হল, ম্যানেজার কানে ধরে বললেন ইংরেজ নয় তিতুমীরই দেশের রাজা। তিতুমীরের হয়ে নীলচাষ করার দৃঢ় শপথ ব্যক্ত করেন তিনি। খুশি হয়ে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়, আর ঘাটে ঘাটে খবর পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করা হয় যেন দেশের রাজা তিতুমীরকে সবাই মান্য করে চলে।

নীলচাষের পয়েন্ট টা খেয়াল করুন।সেই নীলচাষ মা নিয়ে একদিন আগুন জ্বলেছিলো বাংলায়! তাহলে কি মনে হচ্ছে তীতুকে? কৃষক বিদ্রোহের নেতা? কৃষকের মসীহা? ভাবুন ভাবুন‚ ভাবা প্র্যাকটিস করুন।

যাকগে এবার ক্লাইম্যাক্সে আসি। এর আগে কিছু খুচরো সংঘর্ষে পিটানি খাওয়ার পর ( নিজেদের অতি অহংকারের জন্যই খেয়েছিল ) অবশেষে ব ঘোড়াচালিত কামানবাহী দশম রেজিমেন্ট কিছু সৈন্যসহ বারাসাতে ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে যোগ দেয়। নারিকেলবাড়িয় পৌঁছে তারা দেখে উন্মুক্ত মাঠে ইউরোপীয় সৈন্যের লাশ সামনে ঝুলিয়ে ওয়াহাবীরা অপেক্ষা করছে। । সাথে সাথেই তাদের দিক লক্ষ্য করে কামান দাগা হয়। তরবারি আর পাকা বাঁশের লাঠি সম্বল করে ওয়াহাবীরা ফাইট দিতে থাকে। ( এর আগে কয়েকটা খুচখাচ লড়াইতে জিতে ওরা ভেবেছিল আ$ল্লাহ তাদের প্রতি ইম্প্রেসড! তাই কামানের গোলার সামনে বাঁশের লাঠি নিয়ে লড়তে গেছিল! বলদের বলদ ! )

যাইহোক খুব বেশিক্ষন এই সার্কাস চলে না। কিছুক্ষণের ভেতরেই বাঁশের কেল্লা ভেঙ্গে পড়ে।
গুনে দেখা যায় ষাট সত্তর জন মারা গেছে মাত্র। অর্থাৎ মোটমাট এই কজনই ছিলো তীতুমীরের বাঁশের কেল্লায়। তবে
ভেতরে প্রচুর বন্দী উদ্ধার করা হয়, আর পাওয়া যায় প্রচুর লুটের মাল।

তিতুমীরের সেনাপতি গোলাম মাসুমকে বন্দী করা হয় ও পরে আলীপুরে ফাঁসীতে ঝুলানো হয়। আর নাটের গুরু তিতুমীর ক্রসফায়ারেই মারা পরে।

✍️সৌভিক দত্ত

তথ্যসূত্র: বাঙালি সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত – ড. অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায়।

Related Posts