বাংলাদেশে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুবিরোধী ষড়যন্ত্রে সক্রিয় হয়ে ওঠে. দু:খজনক হলেও সত্য, বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্যতম প্রধান কুশীলব ছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। জিয়া ও তার পরিবার বঙ্গবন্ধু হত্যার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী এবং সেই সুবিধাভোগীদের সৃষ্ট উপজাত হচ্ছে আজকের জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন দলিলে উঠে এসেছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারকে হত্যায় জিয়াউর রহমান ও খন্দকার মোশতাকের দীর্ঘ নীলনকশার সব তথ্য। জিয়াউর রহমান নিজের সুবিধার স্বার্থে বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় মদদ দিয়েছিল এবং স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তির সহায়তায় বিএনপি নামের এই সংগঠন গড়ে তুলেছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পূর্বে খুনিরা উপ-সেনাপ্রধান হিসেবে কর্মরত জিয়াউর রহমানের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য তাদের নিজেদের মতো করে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন জিয়া। শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে জিয়ার প্রত্যক্ষ সমর্থনের কারণে আরো এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার সাহস পেয়েছিল মোশতাক চক্র। ফলে, জিয়া-মোশতাকদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট ইতিহাসের নিকৃষ্টতম হত্যাকান্ড প্রত্যক্ষ করে এই বিশ্বচরাচর। এই কালরাতে বর্বরভাবে হত্যা করা হয় বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের। স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি এবং পাকিস্তানি এজেন্টদের সাথে হাত মিলিয়ে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে অবৈধ উপায়ে ক্ষমতায় আসে। তার এই অবৈধভাবে ক্ষমতা গ্রহণকে বৈধতা দেওয়ার লক্ষে এবং তার অবৈধ ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে স্বাধীনতা বিরোধীদের বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে তাদের সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল(বিএনপি)। জিয়াউর রহমানের সময়ে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ দিয়ে বিএনপি পথচলা শুরু করেছিল স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির একটি প্যাটফর্ম হিসেবে। সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত স্বাধীনতা বিরোধীরা সন্ত্রাসী সংগঠন বিএনপির ছায়াতলে থেকে বাংলাদেশকে লুটেপুটে খেয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে মূলত স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশকেই খুন করার অপচেষ্টা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, হাজার বছরের বহমান জাতীয় সংষ্কৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়। উগ্রবাদ ও অসহিষ্ণুতার রাজনীতি শুরু হয় দেশে। বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণ করতে কুঠারাঘাত করা হয় অর্থনৈতিক সংষ্কার পরিকল্পনাগুলোতে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারী সরকারগুলোর সঙ্গে রাতারাতি পাকিস্তানি জান্তা ও উগ্রবাদী কিছু রাষ্ট্রের অভিনব সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্বাধীনতা বিরোধী দল বিএনপির উত্থানই হয় বন্ধবন্ধুকে হত্যার মোটিভ নিয়ে এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি জামায়াত-শিবিরের প্যাাটফর্ম হিসেবে বিএনপির প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যে অর্ডিন্যান্স জারি হয়েছিল সেই অর্ডিন্যান্সকে পার্লামেন্টে নিয়ে এসে পাশ করেছে বিএনপি। সেই সময়ে অর্ডিন্যান্সে সাক্ষর করেছেন জিয়াউর রহমান।বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বঙ্গবন্ধু হত্যার বৈধতা দিয়েছিলেন বিএনপির জিয়াউর রহমানই। এরশাদ সাহেব ক্ষমতায় এসেও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দিয়ে রাজনীতি করিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসী শক্তির উপর ভর করে তাদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা দিয়ে ক্ষমতায় টিকে ছিল।
স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি এবং যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে গড়ে ওঠা এই বিএনপি সংগঠনের জায়াতলে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্তস্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তিগুলো থেকে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে তাঁদের অপপ্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পরে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯১ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ বিএনপি এবং তাঁর সাথে যুক্ত স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির অপশাসনের ফলে দেশ দূর্নীতি, জঙ্গিবাদ এবং ধর্ষণের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিলল। মুজিব হত্যার মাধ্যমে ঘাতকরা মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায় আঘাত হানে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুধু দেশ স্বাধীনের লড়াই ছিল না, এটি ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের জনযুদ্ধ। ভাষা আন্দোলনে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার যে জাগরণ শুরু হয়, তারই পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটে মুক্তিযুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল একটি ন্যায়সঙ্গত আবাসস্থল প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দেশ গিয়ে পড়ে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর হাতে। স্বাধীনতা বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ও স্বৈরশাসকরা প্রথমেই ‘জয় বাংলা’র পরিবর্তে পাকিস্তানি কায়দায় উর্দু শব্দে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’-এর প্রচলন করেন। ‘বাংলাদেশ বেতার’ এর নাম পরিবর্তন করে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ করা হয়। সংবিধানের মূলনীতির পরিবর্তন ঘটিয়ে একে সাম্প্রদায়িক চেহারা দেওয়া হয়। বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। ৭১-এর যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, আলবদরদের পুনর্বাসন করা হয়। হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনা, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিকে বৈধতা দান ও তাদের ক্ষমতায়ন করাই ছিল ১৯৭৫ পরবর্তী সরকারগুলোর মূল কাজ। ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে একের পর এক সেনা অভ্যুত্থান, সেনাবাহিনীর অন্তর্দ্বন্দ্ব, মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্যদের হত্যা ও তাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলে। ৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৮১ সালের ৩০ মে পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ২২টি সেনা অভ্যুত্থান ঘটে, যা দেশের চরম অরাজক চিত্রই তুলে ধরে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে এ দেশে পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণার পুনর্প্রচলনের অপচেষ্টা চলে। পাঠ্যপুস্তক থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার সব রকম চেষ্টা দেখা যায়। গণআন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়। এমনকি জাতীয় সংগীতেরও অবমাননা করা হয় বিভিন্নভাবে। সেসময় অনেক সরকারি অনুষ্ঠানেও জাতীয় সংগীতের পরিবর্তে শুধু সুর বাজানো শুরু হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের কাজ বন্ধ হয়ে যায় এবং সামাজিকভাবে তাদের হেয় করা হয় বা একঘরে করা হয়। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের কাজও কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। গণতন্ত্রকে রুদ্ধ করে চলে স্বৈরতন্ত্রের তান্ডব। বঙ্গবন্ধু হত্যা তাই জাতির জন্য বয়ে আনে দীর্ঘস্থায়ী দুর্ভাগ্যের কালো মেঘ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক্সিকিউটিভ ইন্টেলিজেন্স রিভিউ (ইআইআর)-থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ১৫ জনকে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার ১৬ দিন পর, ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট, পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোরবিরোধী সৌদি আরব বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পরপরই বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পাকিস্তান রেডিও বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের খবর জানানোর পাশাপাশি গৌরবের সঙ্গে প্রচার করেছিল, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নাম বদলে ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ হয়েছে’। তবে বাংলাদেশের নাম বদলানোর বিষয়টি পরে অস্বীকার করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের মাধ্যমে বিএনপির সাহায্যে বাংলাদেশের ওপর স্বাধীনতাবিরোধী আন্তর্জাতিক বলয়ের প্রভাব শক্তিশালী হয়। তারা নিজেদের ভাবধারার প্রচারের পেছনে বাংলাদেশে অর্থ লগ্নি করে। এভাবেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির প্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে ওঠে বিএনপি।
সুতরাং বিএনপি মূলত সন্ত্রাসী সংগঠন যার শুরুটা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে। এই সংগঠন মূলত স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিগুলোর সমন্বয়ে গঠিত একটি সংগঠন যারা কোনোদিন বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় বিশ্বাসী ছিলেন না। শুরু থেকেই তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে পাকিস্তানি শাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং এখনো তারা সেই লক্ষ্যেই তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে চলেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের শক্তিতে বিশ্বাসী বাঙালি জনগণের উচিত বিপুল সমর্থন দিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করা। বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের মতো স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে এগিয়ে আসা। তাহলেই বেঁচে যাবে দেশ ও দেশের মানুষজন।
তথ্য: সকালের সময়