বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর যা চলছে তাকে জাতিসংঘের ভাষায় এক কথায় বলে জেনোসাইড, যার মানে দাঁড়ায় হিন্দু জেনোসাইড। জেনোসাইড শব্দের বাংলা অর্থ কিভাবে যেন হয়ে গেছে গণহত্যা, অথচ হওয়ার কথা ছিল গণনিধন, জাতীয়তা(Nationality), জাতিগত(Ethnicity) বা ধর্মীয়(Religious) পরিচয়ের ভিত্তিতে জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে সেটা হত্যাযজ্ঞ হতে পারে আবার উচ্ছেদের উদ্দ্যেশ্যে সাস্কৃতিক আগ্রাসন, এথনিক ক্লিনজিং, ভয়ভীতি প্রদশর্ন, গালাগাল ইত্যাদিও হতে পারে । কিন্ত, একশ দুইশ জন নয়, লাখ লাখ মানুষ হত্যা না হলে এটাকে বাঙালিরা জেনোসাইড বলতে রাজি না। অথচ, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার সংজ্ঞা অনুসারে গণহত্যা জেনোসাইডের একটা অংশ, শুধু গণহত্যা মানেই জেনোসাইড নয়। জেনোসাইড হওয়ার আরও কিছু শর্ত আছে, গণহত্যা না হয়েও একটা স্থানে একদল মানুষের বিরুদ্ধে জেনোসাইড হতে পারে। UNHRC এর ওয়েবসাইট থেকে তাদের জেনোসাইডের সংজ্ঞাটা যে কেউ গুগলে একটা সার্চ দিলেই পেয়ে যাবেন।
জাতিসংঘের কনভেনশন অন দা প্রিভেনশন এন্ড পানিশমেন্ট অফ দা ক্রাইম অফ জেনোসাইড এ জেনোসাইড বলতে নিম্নোক্ত যে কোনো কাজকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে কোনো জাতীয়তা(Nationality), জাতিগত(Ethnicity) বা ধর্মীয়(Religious) পরিচয়ের ভিত্তিতে জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে সংঘটিত হওয়াকে বুঝায় –
১। জনগোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা।
২। জনগোষ্ঠীর সদস্যদের গুরুতর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করা;
৩। সচেতনভাবে জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনে এমনভাবে আঘাত করা যেন তা সম্পূর্ণভাবে বা আংশিকভাবে ধ্বংশ হয়ে যায়।
৪। জনগোষ্ঠীর জন্ম রোধ করার উদ্দেশ্যে জন্ম প্রতিরোধ ব্যবস্থা আরোপ করা।
৫। এক জনগোষ্ঠীর শিশুদের জোর করে অন্য জনগোষ্ঠিতে রুপান্তর করা।
খেয়াল করুন, সংজ্ঞায় বলা আছে উল্লেখিত পাঁচটা শর্তের মধ্যে যেকোন একটা শর্তই যদি পূরণ হয় তাহলেই সেটাকে জেনোসাইড হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের হিন্দুদের মধ্যে তো পাঁচটার মধ্যে প্রথম তিনটা শর্তই পূরণ হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে হিন্দু জেনোসাইডের ইতিহাস শুধু বাংলাদেশ থেকে মানে ১৯৭১ থেকে শুরু করলে হবে না। এই জেনোসাইডকে বুঝতে হলে আমাদেরকে শুরু করতে হবে ১৯৪৬ সালের নোয়াখালি হিন্দু গণহত্যার সময় থেকে। বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর যে জেনোসাইডাল কার্যক্রম চলছে তার শুরু সেই দেশভাগ থেকে। ইতিমধ্যে এই অঞ্চলে পাঁচ পাঁচটা হিন্দু গণহত্যা সংগঠিত হয়ে গেছে, তার পাশাপাশি প্রতি বছরই হয়েছে অসংখ্য গণনিপীড়ন। আর এই সবগুলো ঘটনার সম্মিলিত ফলাফল হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে বিশাল সংখ্যক হিন্দু জনগণ গায়েব হয়ে যাওয়া। এই গায়েব হয়ে যাওয়া হিন্দুদের বড় অংশই পাশের দেশ ভারতে মাইগ্রেট করেছে, বাকিরা ধর্মান্তরিত হয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে।
জেনোসাইড মানেই যে লাখ লাখ মানুষের গণহত্যা হতে হবে এমনটা কিন্তু না। পৃথিবীর যেখানে যেখানে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে তার বেশিরভাগই লাখের ঘর পার করে নাই। আমেরিকার ওকলাহোমা কাউন্টিতে ১৯১০ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ান জাতিগোষ্ঠীর ৬০+ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছিলো। জাতিগত পরিচয়ে তাদেরকে নির্মুল করার উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়েছিল বলে এই ঘটনাকেও কিন্তু জেনোসাইড হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। শুধু গণহত্যা হলেই তা জেনোসাইড হয় না। এখানে দেখা হয় সেই হত্যাকান্ডের পেছনে জাতীয়তা(Nationality), জাতিপরিচয়(Ethnicity) কিংবা ধর্ম পরিচয়ের ভিত্তিতে একটা জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার উদ্দেশ্য কাজ করেছিল কিনা। যদি এরকম উদ্দেশ্যেই করা হয়ে থাকে তাহলে ৬০ জন মানুষ হত্যাকেও জেনোসাইড হিসেবে স্বকৃতি দেয়া যায়। আবার যদি দেখা যায় রাজনৈতিক মারামারি করে এক রাজনৈতিক দলের কর্মীরা আরেক দলের কর্মীদের হাজারে হাজারে মেরে ফেলেছে, সেটা কিন্তু জেনোসাইড নয়। সেই কারণেই এবারের বাংলাদেশে সরকার পতনের আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকার যে হাজারের উপর আন্দোলনকারীকে হত্যা করল কিংবা আন্দোলনকারীরা যে কয়েক শত পুলিশ সদস্য হত্যা করল এগুলো জেনোসাইড হিসেবে গণ্য হবে না।
বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানে ইতিমধ্যে হিন্দুদের উপর গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে পাঁচ বার। ১৯৪৬ থেকে শুরু, এরপরে ১৯৫০, ১৯৬৪, ১৯৬৫ এবং সর্বশেষ সংঘটিত হয়েছে ১৯৭১ সালে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যে পাকিস্তানের আর্মিরা মূলত হিন্দুদেরকে টার্গেট করেই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল এবং হিন্দুদেরকে দেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করাটাই তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল এই ইতিহাস একেবারে মুছে ফেলা হয়েছে। যে কারণে দেশ স্বাধীণ হওয়ার পরে যেসকল মানুষ যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন তাদের কোন নাম পরিচয় রাখা হয় নাই। কেননা, দেশের শাসক ও মূলধারার বুদ্ধিজীবীমহল বুঝতে পেরেছিলেন যদি নিহতদের নাম পরিচয় সংরক্ষণ কাজ শুরু করা হয় তাহলে এটা যে মূলত একটা হিন্দু গণহত্যা ছিল তা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। এই কারণে পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানীদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকান্ডকে শুধুমাত্র বাঙালি হত্যাকান্ড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, কিন্তু নিহতদের নাম পরিচয় সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ নেয়া হয় নাই। তবে ভারত সরকারকে একটা ধন্যবাদ দিতে হয় এইজন্য যে, তারা বাংলাদেশ থেকে যাওয়া স্মরণার্থীদের নাম পরিচয় লিপিপদ্ধ করেছিলেন বলেই অন্তত এটা জানতে পারা যায় যে, এইসব স্মরণার্থীদের শতকরা ৯০ জনই ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু।
স্বাধীণ বাংলাদেশে হিন্দু গণহত্যা হয়নি তবে বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্নভাবে হত্যাকান্ড, লুটপাট, জবরদখল, ধর্ষণ, ধর্মান্তর মানে নিপীড়নমূলক যত ধরণের কর্মকান্ড আছে তার সবটাই সংঘটিত হয়েছে। অর্থাৎ, জেনোসাইড কনভেনশনের দুই নম্বর ও তিন নম্বর শর্ত খুব স্পষ্টভাবেই পূরণ হয়েছে। সময়ে সময়ে এইসব নিপীড়ন গতিশীল হয়ে বিভিষীকাময় পরিস্থিতিও তৈরি করেছে। বছরের প্রতিটা মাসই কোন না কোন ঘটনা দেশের কোথাও না কোথাও নিপীড়নের ঘটনা ঘটে চলেছে। ১৯৯২, ২০০১, ২০২১ এবং এবারের ২০২৪ এই চারটা বছরে যা যা হচ্ছে তার তুলনা বিভীষিকার সাথেই চলে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দু শিক্ষক সহ উচ্চ পদস্থ চাকরিজীবীদের জোর করে পদত্যাগ করানো কিনবা বাংলাদেশ পুলিশের একটি ব্যাচ এর ৯৯ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ৯১ জনকে ঠুনকো অযুহাতে চাকরিচ্যুত করাও চলমান জেনোসাইড প্রক্রিয়ার অংশ। এতদিন যেহেতু গণহত্যা হয়নি, আর কি কোনদিন হবে না? এই কথা কি গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় সামনের দিনগুলোতে আর কোনদিনই বাংলাদেশে হিন্দু গণহত্যা হবে না? যদি হয় তাহলে কি তা কিভাবে কখন শুরু হবে? তা কি আগে থেকে বুঝা যাবে?